চাকরিওলার মৃত্যু

সময় দুটো। ট্রেন দুটো পনেরোয়। স্টেশন প্রায় এক কিলোমিটার। বেরোনোর ঠিক আগে জয়ন্তীদি ঘড়িটা দেখে আমাকে সুন্দর করে গুছিয়ে বুঝিয়ে দিলো, “তুই রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই দেখে নিবি কাছাকাছি রিক্সা আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে তুই পাঁচ মিনিট নিশ্চিন্তে অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবি। পেয়ে গেলে তো ভালো, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবি। না পেলে, রিক্সাটাকে ডেকে নিবি। চিন্তা নেই ট্রেন পেয়ে যাবি।”

এতো গোছানো পরামর্শে আমরা অনেকেই হাসাহাসি করলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম।

রাস্তায় বেরিয়ে এক মিনিটের মধ্যে দুটো অটো গেলো। ফাঁকা ছিলো না। রিক্সা দেখার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। হঠাৎ দেখি এক রিক্সাওলা খুব হাসিহাসি মুখ করে খুব দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসছে। জয়ন্তীদির দেওয়া পরামর্শ ভুলে জিজ্ঞেস করলাম, স্টেশন যাবেন?
-- হ্যাঁ, বুঝতেই পেরেছি।
-- কত নেবেন?
-- যা হোক দেবেন।
-- দশ?
-- আপনার যা ইচ্ছা।
-- বললাম, দুজনের কুড়ি, একজনের কেউ কেউ নানানরকম ভাড়া বলে।
-- ও আপনি যা ইচ্ছা তাই দেবেন।

বোঝা গেলো, সে আমাকে তার রিক্সায় চাপাতে পেরেই বর্তে গেছে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না।

একটু পরেই রিক্সার স্পিড বাড়তে থাকলো দেখে আমি আগেভাগেই ধরে বসলাম।

সেটা বুঝেই আমাকে সাবধান করলো -- ভালো করে ধরে বসুন। না হলে মুশকিল।
-- কিসের মুশকিল?  রাস্তা খুব খারাপ? নাকি আপনি আর জোরে চালাবেন?
-- না, মুশকিল হল আপনাদের মতো লোক মরলে ... আমরা কেশ খেয়ে যাবো।
-- কেশ? কিসের কেশ?
-- আপনারা মরলে কেশ দিয়ে দেবে।
-- কেন? আমরা কারা?
-- আপনারা আপিসে কাজ করেন, চাকরিওলা।
-- ও। আচ্ছা।
-- আপনি এদিকে কতদিন আসছেন?
-- অনেকদিন।
-- কতদিন বলুন না।
-- হুম, তা হয়ে গেলো বেশ কয়েক বছর।
-- কোথায় আছেন? মিশনে? মানে মিশনে চাকরি করেন।
-- হ্যাঁ।
-- আসেন কোথা থেকে?
-- ওই কলকাতা।
-- কলকাতার কোথায় বলুন।
-- গড়িয়া।
-- গড়িয়ার কোথায়? গড়িয়ায় তো অনেক জায়গা আছে। কামালগাজি, সন্তোষপুর, মহামায়াতলা…
তাকে থামানোর জন্যে তাড়াটাড়ি বললাম -- ওই কালীতলা।
-- ও, কালীতলা?
-- হুম। চেনেন?
-- না, আমি যাদবপুর, সন্তোষপুর, বাঘাযতীন সব জায়গায় রিক্সা চালিয়েছি।

মনে হলো ভাগ্যিস আমার থাকার জায়গাটা বলিনি।

-- ও, আপনি রিক্সাটা এখান থেকে টেনে টেনে নিয়ে গেছিলেন?
-- না, ওখানে ভাড়ার রিক্সা ছিলো। ভাড়া ধরা ছিলো, এখান থেকে গিয়ে চালাতাম।
-- ও, তাই বলুন। আমি ভাবলাম এটাই চালিয়ে নিয়ে গেছিলেন।
-- আপনার বাড়ি কোথায়?
-- এই এখানেই, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ওই পাড়ায় আমি থাকি।

আমি হাজার প্রশ্ন শুরু করছি দেখেই মনে হয় সে চুপ করে গেলো। তারপর ভাড়া দেওয়ার পর বললো -- আবার আসবেন।

স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, যাবো তো বটেই। দেখা হলে যে প্রশ্নটা করতে ভুলে গেছি, সেটাই আগে করবো।

আমার আগে সে কজন ‘চাকরি-বিহীন’ মানুষকে মেরেও ‘কেশ’ খায়নি সেটা।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত