মকর

“অতো মকরচাল খেয়ে পেট ব্যথা করে কি মরবি? এমনিতে রোগ নেই বললেই তো চলে, আজ পেটে ব্যথা, কাল পায়ে ব্যথা। তার উপর আরো লুকিয়ে লুকিয়ে চালগুলো খা পরে বুঝবি। রাত থেকে তো আবার পিঠের মুখ চলবে।”

আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে মকরচাল খেতাম। আর মা অমন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সাবধান বাণী শুনিয়ে যেতো।
আমরা আমাদের মতো বিচার করতাম কাদের বাড়ি থেকে দেওয়া চালটা ভালো খেতে। ব্রাহ্মণদের জেঠিমারা, বা আমাদের পুরোহিত পুজো করে পাওনা চাল থেকে আমাদের অনেক মকরচাল দিয়ে যেতো। মকরচাল আসলে দুধে ভেজানো আতপচাল। তাতে আর কি মেশাতো জানি না, তবে পুজো করার পর আমরা পেতাম, তাই অনেক গাঁদাফুলের পাপড়ি থাকতো।

আজ মকরসংক্রান্তি। এই দিনেরই একটা ঘটনা প্রতিবছর মনে পড়ে। আমি তখন খুব সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়তাম। আমাদের গ্রামের জানাদের বাড়িতে প্রতিবছর এই দিনে মনসা পুজো হয়। আমি সে বছর ওদের বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুজো দেখার সময় একটা মেয়ে এসে আমাকে বললো, “আমার মা তোকে একবার ডাকছে আমাদের বাড়ি চল!” আমি প্রথমটায় কেমন ভয় পেয়ে থতমত খেয়েছিলাম, কি জানি কোনো দোষ করিনি তো! ডাকছে কেন? আমার সঙ্গে তো এদের খুব ভালো জানাশোনা নেই। ভয়, উৎকন্ঠা, কৌতুহল, সবকিছু নিয়েই তার সঙ্গে তাদের বাড়ি গেলাম। জানাদের বাড়ির সামনেই বাড়ি, এক মিনিটের দুরত্ব। মেয়েটির সম্পর্কে তখন আমি বেশি কিছু জানতাম না, শুধু এটুকু জানতাম যে ওর নাম টুম্পা, আর ও আমার থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ে। নিচু ক্লাসে পড়ে যারা তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়, অত জানার আগ্রহও ছিল না।

ওদের বাড়িতে যেতেই ওর মা (এখন কাকিমা বলি) আমাকে বললো “তুই আমার মেয়ের সঙ্গে মকর পাতাবি? ওর তোকে খুব পছন্দ!” আমি 'মকর' কথাটা শুনে খায় না মাথায় দেয় কিছুই বুঝলাম না! সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “আমার মা যদি আমাকে বকে! ঠিক আছে ও আগে আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি গিয়ে আমার মাকে বলুক, মা যা বলবে তাই হবে!”

আমি টুম্পাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে ভয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মেজদি দেখতে পেয়ে আমাকে ডাকলো। আমি ওকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে মেজদিকে সব বললাম। ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, নিয়ে আসিনি শুনেই মেজদি তো খুব খেপে গেলো। তারপর সে টুম্পাকে ভিতরে নিয়ে এলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে মা সব শুনে হেসেছিল, তারপর আমাদের দুজনকে ডিমভাজা, দুধ আর আলুভাতে দিয়ে ভাত খাইয়েছিল।

আমরা দুজনে খেয়ে নিয়ে আবার ওদের বাড়ি চলে গেলাম। ওখানেই মকর পাতানোর পর্বটা ঘটেছিল। টুম্পার এক পিসি দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের মকর পাতানো ব্যাপারটা শিখিয়ে দিল। মকর পুজোর চাল নিয়ে ও আমার মাথায় তিনবার আর আমি ওর মাথায় তিনবার দিয়ে দুজনেই দুজনকেই বললাম, “তুমি আমার মকর, আমি তোমার মকর”। ব্যাস এটুকুই। আমি প্রথমে বুঝতে না পেরে চালসহ থালাটাই ওর মাথায় তুলে দিচ্ছিলাম। তাই নিয়ে ওরা খুব হাসাহাসি করেছিল।

তখন থেকেই টুম্পা আমার মকর হলো। ও আমাকে মকর বলেই ডাকে, আর আমার মাকে মকরমা। আমি টুম্পা বলি, আর ওর মাকে কাকিমা, কারণ মকর নামটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু প্রতিবছর এই দিনটাতে আমার ওই ঘটনাটা মনে পড়ে যায়! তবে টুম্পার সংগে আমার শেষ কবে দেখা হয়েছে মনে নেই। গ্রামে গিয়ে আবার কবে দেখা হবে জানি না। তবে ফেসবুকে এলে আবার আগের মতোই গল্প হবে।

আজ একটুও মকরচাল খাইনি। তাই মায়ের বকাও খেতে হয়নি। কাদের বাড়ির চালটা কেমন স্বাদের সেটাও জানা হলো না।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত