সবজিওয়ালা - ২

এরপর একদিন অনেক রাত হয়েছিলো, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছে করছিলো। তবুও দাদু একা বসে আছে দেখে থেমে গেলাম। আমাকে দেখে দাদু হাসলেন। তার মধ্যেই এক মহিলা এসে পটলের দরদাম করতে লাগলেন, ফলে আমাকে আর আলাদা করে দাম জিজ্ঞেস করতে হলো না। দাদু কখনো এক কেজির দাম বলেন না, সবসময় দেখি পাঁচশোর দাম বলেন। পাঁচশো পনেরো টাকা।

মহিলা জানতে চাইলেন, “ছশো হবে? পনেরো টাকায়?” দাদু জোর গলায় বললেন, “না।” তিনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আড়াইশো দিন।”

আমি শুরু করলাম, “দাদু কলকাতায় এসে কি হলো তারপর?”

সবজিওলারা হয়তো আশাই করে না কেউ এক কেজি কিনবে, তাই পাঁচশো দিয়েই দাম বলে। কেউ কেউ আড়াইশো দিয়েই দাম বলা শুরু করে।

“তারপর এদিক সেদিক এদিক সেদিক করে করে করে…”
“এদিক সেদিকটা কি?”
“এই তো চায়ের দোকান, হোটেল, তারপর একটা ছাপাখানা…”
“কিসের ছাপাখানা?”
“কাপড়ের রঙ করার। তারপর আবার এমব্রয়ডারির কাজ শিখলাম। বিয়ে হলো সংসার বাড়লো…”

ওই মহিলা বলে উঠলেন, “কত হয়েছে আমারটা?”
“আট টাকা। আট টাকা দিন।”
“পঞ্চাশ টাকা খুচরো হবে?”
“না, খুচরো দিন। আজ একটুও খুচরো হবে না।”
“তিনি দশ টাকা দিয়ে দুটাকা ফেরত নিয়ে পটল নিয়ে চলে গেলেন।”

আমি চুপ করে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে। দাদু তাঁর নিজের কথা বলেই চলেছেন, আমাকে আর জিজ্ঞেস করতে হয়নি। কথা বলতে বলতে আমাকে পটল দেওয়ার আগে, তাঁর পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো মুখ বিকৃত করে বেশ খসখস করে চুলকে নিলেন। আমার একটু কেমন কেমন লাগতে শুরু করলো। তারপর ভাবলাম আচ্ছা ঠিক আছে এতো কেমন কেমন হওয়ার কিছু নেই, সবজি কাটার আগে আমি তো ধুয়েই নিই। এটা মনে করে আগে ধুতে হবে।

দাদু আবার শুরু করলেন, “আমার খুব কষ্ট। সারাজীবন খুব কষ্ট করেছি, বাবা-মা’র আদর পাইনি। এই কষ্ট করে করে….”
আমি বললাম, “দাদু এমন করে বললে হবে না, কোথায় কোথায় কাজ করেছেন ঠিক ঠিক করে বলতে হবে। এমন করে করে করে বলে ছেড়ে দিলে হবে না, আমি লিখবো।”
লিখবো শুনে দাদু খুব খুশি, “আপনি গল্প লেখেন?”
“না গল্প লিখিনা, তবে টুকটাক কিছু কথা লিখি। আপনার কথা লিখেছি, অনেকে পড়েছে।”
“সবাই কি বললো? তারা ভালো বলেছে? খুশি হয়েছে?” বলার সময় চোখে-মুখে হাসি, খুশি দুটোই ছিলো।
আমি বললাম, “হ্যাঁ ভালো বলেছে, বলেছে দাদুর পুরো গল্প শোনার অপেক্ষায় আছি।”

সেই শুনে বললেন, “সেই হোটেলটা ছিলো গণেশ চাকির ওখানে।”
ওনার উচ্চারণে আমি এটাই শুনেছি।
“সেটা আবার কোথায়?”
“ওই যে, বড় বাজারের ওখানে। আগে ওখানেই থাকতাম।”
“আপনার নাম কী?”
“আমার নামও গণেশ।”
“গণেশ কী?”
“গণেশ সেন।”
“বললাম সেন?”
“হ্যাঁ, সেন।”
“ঠিক আছে, পরেরদিন আবার ভালো করে বলবেন। আজ দেরি হয়ে গেছে বাড়ি যাই।”

আমার আশি টাকা হয়েছিলো, একশো দিলাম। তখন দেখলাম পকেট থেকে দশ-কুড়ির নোটের খুচরোসহ একটা মোটা বান্ডিল থেকে আমাকে কুড়ি টাকা ফেরৎ দিলেন। আমি তখন আর মনে করিয়ে দিলাম না যে একটু আগেই তো বলছিলেন খুচরো নেই!

যখন চলে আসবো, তখন বললেন, “এখন আমার একটু তাও ভালো অবস্থা, এইটা করছি বলে।”
“এইটা কি?”
“এই সবজি বিক্রি করা।”
“কতদিন করছেন এটা?”
“পনেরো বছর মতো হলো।”

আমার মনে হলো, অন্যের দোকানে কাজ করা, আর নিজের স্বাধীন ব্যবসার মধ্যে যে তফাৎ তার মধ্যে থেকেই হয়তো শান্তিটাকে আলাদা করতে পেরেছেন।

শুক্রবার ২৬.০৫.১৭

দাদু আজকাল খেয়াল রাখছেন, আমি প্রতি শুক্রবার যাই কিনা। আগের শুক্রবার যাইনি, তাই দেখেই প্রথম প্রশ্ন,  “আগের শুক্রবার আসেননি কেন?” আমি কারণটা বললাম। দাদুর কথা লিখি জানতে পেরে দাদুর গল্প বলার ইন্টারেস্ট খুব বেড়ে গেছে। বললাম, “গল্পটা তারপর শুরু করুন।” এক মহিলা শুনে বললেন, “আপনি গল্পও শোনান নাকি?” দাদু হাসলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কলকাতায় এসে বিয়ে করলেন কবে?” তিনি বললেন, “কলকাতায় আসার চার বছর পর।” আমি একটু বয়সের হিসেব মেলাতে লাগলাম মনে মনে। তাতে মনে হলো দাদু হয় খুব বয়সে পড়াশুনো শুরু করেছিলেন, নয় খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছেন। বলেছিলেন ক্লাস সিক্স পরীক্ষা দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।

“তখন আপনি কিসের কাজ করতেন?”
“তখন আমি নিজে কাপড় কিনে ফেরি করতাম।”
“থাকতেন কোথায়?”
“নিমতলা স্ট্রিটে। তারপর তিনজন হলাম। পুঁজিতে টান পড়লো। তখন আমি আবার কাপড়ের দোকানে কাজে ঢুকলাম।”
“তাতে পুঁজির মেক আপ হলো? কত টাকা দিতো?”
“চার হাজার টাকা মাইনে দিতো। তখনকার দিনে চার হাজার মানে অনেক।”
“হুম।”
“তারপর আরো লোক বাড়লো।”
“আপনার কয় ছেলেমেয়ে?”
“দুই ছেলে, এক মেয়ে।”
“সবাই লেখাপড়া করেছে?”
“হ্যাঁ, ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক, মেয়ে বি. এ পড়তে পড়তে বিয়ে করে ফেলেছে। আর ছোট ছেলেটা বেশি পড়লো না। কিন্তু ওটাই ভালো বেরিয়েছে। মেয়েটা আমার খুব ভালো ছিলো।”
“ছিলো কেন?”
“আর নেই তো!”
“কি হয়েছে?”
“বিয়ের পর, শ্বশুর বাড়িতে মেরে দিয়েছে।”
“মেরে দিয়েছে মানে?”
“হ্যাঁ, মেরেই দিয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। আজ আমার মেয়ে থাকলে বসে খেতাম। এতো কষ্ট করতে হতো না।
মারলো কেন?”
“কেন মেরেছে জানি না, তবে শাশুড়ি খুব বদমাশ ছিলো। কি হয়েছে, আমার বাড়ির পাশে এক বুড়ি থাকতো। তার বাড়িতে একটা ছেলে আসতো। আসতে আসতে আমার মেয়ের সঙ্গে প্রেম হলো। মেয়ে বললো ওকেই বিয়ে করবে। আমরা তখন ছেলের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের বাড়ি বীরভূমে। ছেলের মা এলো। বললো আমাদের কোনো দাবি নেই। আমি তবুও খাট-বিছানা, হাতের, কানের, গলার দিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম। ওখানে প্রায় দিনই শাশুড়ির সঙ্গে অশান্তি লেগে থাকতো। জামাই কিছু করতে পারতো না। একদিন শাশুড়ি আর ভাসুর মিলে গায়ে কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।”
“বিয়ের কতদিন পর?”
“বিয়ের ছবছর পর।”
“মেয়ের বাচ্চা-টাচ্চা নেই?”
“না, নেই।”
দাদু বলতে থাকলেন, “তারপর খবর পেয়ে আমার তো মাথা গরম। আমি ভেবেছিলাম, আমি ওদের নামে কেশ দেবো না, কিন্তু ওইদিনই ওই দুজনকে জ্বালিয়ে দেবো। কিন্তু বুড়ি কিছুতেই দিতে দিলো না। বললো, এসব করতে যেও না। আমাদের মেয়ে তো ফিরে পাবো না। যা যাওয়ার চলে গেছে। তুমি এসব করলে আবার কি থেকে কি হয়।”
“তারপর?”
“তারপর পুলিশ কেশ হলো। কেশ চলতে থাকলো। আমি ভাবলাম আমাদের তো খরচ নেই, চলুক। তাদের জেল হলো। কিন্তু একবছর জেলে থাকার পর জামিন হলো, কিন্তু কেশ চলতে থাকলো। তারপর ভেবে দেখলাম, আমাদের যাতায়াতে তো খরচা হয়ে যাচ্ছে। গরীব মানুষ। আর এসব চলেই কি হবে, মেয়ে তো আর ফিরে পাবো না। আমার মেয়ে খুব ভালো ছিলো।”

এই খবরটা খারাপই লাগলো। একদম রোজকার কাগজে যা পড়ি তাই।

এই গল্প চলতে চলতেই একজন ভদ্রলোক স্কুটি চালিয়ে এলেন। স্কুটির সামনে দাঁড়িয়ে ফুটফুটে একটি বাচ্চা। বয়েস সাড়ে তিন চার হবে। দাদু সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছো? এতোদিন আসোনি কেন? আজ কি খাবে? শশা?”
বাচ্চাটা বললো, “বাড়িতে আছে।”
তখন দাদু বললেন, “তাহলে কি খাবে লেবু? বলেই একটা আমলকি হাতে নিয়ে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে, এটা খাও, এটা খুব ভালো জিনিস।”
বাচ্চাটা কেমন মিহি সুরে বললো, “আমাকে দিও না গো। বলেই, যে দরজার বাইরে দাদু বসে সেই দরজা ঠেলে তার বাবার সঙ্গে বড় ভিতরে ঢুকে গেলো।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “ছেলেরা কি করে?”
তখন বললেন, “বড়ছেলে এমব্রয়ডারির কাজ করে। কিন্তু খুব বেশি আয় হয় না। এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার। যখন আসে তখন আমাকে এটা চায়, সেটা চায়। টাকা চায়। বুড়ি খুব রাগ করে। বুড়ি বলে ও আমাদের দেখে না। ওকে নিজে আয় করে তো, ওকে কিছু দেবে না। আমি বুড়িকে বলি, তা বললে হয়, ছেলেমানুষ। আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে দি।”
“আসে মানে কি? কোথায় থাকে?”
“হাওড়া আন্দুলে থাকে। এই তো কদিন আগেই এসেছিলো। বললো, বাবা আমার বেল্ট নেই। আমি লুকিয়ে একশো টাকা দিয়ে বেল্ট কিনে দিলাম। যাওয়ার সময় বললো বাস ভাড়া নেই। তাও দিলাম। এরম একশো, দুশো করে দি যখন আসে। ছোটটা এখনো বে থা করেনি। ব্যাঙ্গালোরে থাকে, কাপড়ের দোকানে কাজ করে। ভালো আয় হয়।”

আবার মেয়ের কথা শুরু করলেন। “মেয়ে আমার খুব ভালো ছিলো। তার মায়ের থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসতো। আমি কোথাও গিয়ে একরাত থাকতে পারতাম না। ঠিক ফোন করে ডেকে নিতো। বলতো বাবাকে চাই। আমি বাড়ি চলে আসতাম।”
“মেয়ে কতদিন হলো মারা গেছে?”
“তা প্রায় সতেরো বছর হবে।”
“এদিকে এসেছেন কতদিন?”
“পঁচিশ বছর হলো এদিকে চলে এসেছি।”
আমি তারপর বললাম, দাদু এবার আমি যাই। আজ এটুকুই লিখি।”
তখন সঙ্গে সঙ্গে দাদু বললেন, “সত্যি লেখেন? লিখবেন তো?”
বললাম, “হ্যাঁ, লিখি তো।”
তখন হাসিমুখে বললেন, “একদিন কিন্তু লেখাটা দেখবো।” 

Comments

Popular posts from this blog

কুলকুলতির ব্রত

অন্ধকারের উৎস হতে