বাঙালি

আগ্রা, অনেক বছর আগে

“তুম কেয়া বাংলা পড়নে জানতে হো?”  
“বলনে ভি জানতা হুঁ।”  
“আচ্ছা! কাঁহা শিখা?” 
“কলকাত্তা। আপনি হিন্দি চালিয়ে যেতে পারেন, বেশ লাগছে।”  
“দূর মশাই! আমি গড়পারের লোক, হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি?”

কলকাতায় সবাই বাংলা বলি। কেউ কারো সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলি না। কিন্তু বাংলার বাইরে গেলে বাংলা ভাষার কদর অনেকটা বেড়ে যায়। এক বাঙালি অন্য বাঙালিকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

১। রোম, ২০০৫

“আপনারে কেমন সেনা সেনা লাগসে।”
হকচকিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “না, আমি তো আপনাকে চিনি না।”
“না, আমার কেমন সেনা সেনা লাগসে। আমি আপনারে কোথায় য্যানো দেখসি।”
“না, কোথাও দেখেননি। আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।”
“না, আপনারে দেখসি।”
খুব সিরিয়াস হয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম -- “শুনুন আসলে আপনার গায়ের রঙ, আমার গায়ের রঙের সঙ্গে কোনো তফাৎ নেই তো, তাই আপনার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে কোথাও দেখেছেন। বিদেশ বিভূঁইতে একটু একইরকম দেখতে লোক মনে হলে আপনার এমন চেনা চেনা লাগতে পারে, কিন্তু আমি আপনার চেনা নই।”

সুদূর রোমে। আমি একা একটা জায়গায় লাগেজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। বর গেছিলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুঁজতে। দশ বারো দিনের বেড়ানোর পর লাঞ্চ করে রোম থেকে ফ্রাঙ্ক্ফুর্টের প্লেন ধরে জার্মানিতে ফেরা বাকি। সেই ফাঁকে ইনি দৌড়ে এসে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করলেন। তখন আমার মনে হচ্ছিলো, আমার একটা ছবি দেখে দাড়িকাকু বলেছিলো, “তোকে এটাতে ঠিক সেখ হাসিনার মতো দেখাচ্ছে।” তাই মনে হয় ওনার আমাকে চেনা চেনা লাগলো।

তিনি কিছুতেই নড়ছেন না দেখে আমিও গল্প শুরু করে দিলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমরা রোমে কতদিন আছি।
“এখানে থাকি না, আমরা ঘুরতে এসেছি।”
“কোথায় থাকেন?”
“জার্মানিতে।”
“ঘুইরা কেমন লাগলো? সব জায়গা দেখা হইয়া গেসে?”
“সব জায়গা এই কদিনে কি সম্ভব? সম্ভব নয়। তাই মেইন মেইন জায়গাগুলো দেখেছি। আপনি এখানে কতদিন আছেন? এখানেই থাকেন?”
“হ। আমরা এইখানেই থাকি তো। দশ - পনেরো বসর হলো সইলা আইসি। আমার পুরা ফ্যামিলি তো এখানে।”
“পুরো ফ্যামিলি মানে?”
“মানে আমার দাদা, কাকা, ভাই, বাবা- মা সবাই।”
“এতো সবাই এলেন কি করে?”
তিনি অবলীলায় উত্তর দিলেন - “সুরি সামারি কইরা সইলা আইসি।”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - “সুরি কইরা মানে?”
“সুরি কইর‍্যা মানে, এই ধরেন প্রথমে আমার সাসা আইলো। তারপর আমারে লইয়া আইলো, তারপর আমি আমার ভাইরে লইলা আইলাম। এইভাবে পুরা ফ্যামিলি।”
“ভিসা পেলেন কি করে?”
“ওইডাই তো সুরি কইরা। ধরেন প্রথমে কোনোরকমে জার্মানির ভিসা করসি, তারপর কিসুদিন ওখানে থাইক্যা, ভিসা শেষ হইয়া যাইবার পর কোনোরকমে বর্ডার পার হইয়া ইটালিতে ঢুকসি।”
“ওরম ঢোকা যায় নাকি?”
“যায় তো। তার পথ জানতে হয়।”
“ভয় লাগেনি?”
“লাগসে, কিন্তু আবার এইভাবে অনেকেই আইসি আমরা।”
“কেন এসেছেন?”
“আইসি, কারণ দেখেন, আমাদের ঐখানে টাকার মূল্য খুব কম। আর কাজ কামও তেমন পাওয়া যায় না। এইখানে কোনোরকমে একবার আইসা গেলে রেস্টুরান্টে কাজ করলেও তো অনেক পয়সা। আমি এখন বাড়িতে যারা আসে তাদেরকেও পয়সা পাঠাতে পারি।”
“এখানে বাড়ি আছে আপনার?”
“হ্যাঁ, ওই যে ওই বাড়িটা দেখসেন, ওটা আমার বাড়ি, পাশেই কাকা থাকে। আমার দোকানও আসে এইখানে।”  
“হুম! দেখলাম তো, এখানে সব বাংলাদেশি দোকান ভর্তি। খাতা-কলমের দোকানও তো দেখলাম। পুরো বাংলায় লেখা, এখানে খাতা কলম পাওয়া যায়।”
“হ্যাঁ, আপনার এইখানে বাংলায় কথা বলতে কোনো অসুবিধা হইব না। বাঙালিই বেশি।”
“আচ্ছা ওই দোকানটায় লেখা আছে, বিজুত্তেরিয়া। এই বিজুত্তেরিয়া মানে কি?”
তিনি লেখাটা দেখলেন, অনেক মাথা চুলকেও মানেটা উদ্ধার করতে পারলেন না। আমিও আজ অব্দি পারিনি। অজানা রয়ে গেছে।

তারপর আমি আমার একটা রাগের কথা উগরে দিলাম। বললাম, “আচ্ছা সমস্ত দোকান, হকার সবই তো দেখছি বাংলাদেশিদের। কিন্তু দোকানগুলোর ভিতরে যখন ঢুকছি তখন তো দেখছি আপনারা শুধু বিদেশিদেরই দেখাচ্ছেন, আমাদের তো পাত্তাই দিলো না কেউ। তার মানে ধরেই নিচ্ছে, যা কেনার ওরাই কিনবে, ওদের অনেক পয়সা। আর আমরা ইউরো খরচ করে কিনতে পারবো না, তাইতো?”
তিনি লজ্জা-টজ্জা পেয়ে, “না মানে আপনার সঙ্গে এমন কে করসে জানি না, কিন্তু আমি কারোর সঙ্গে এমন করি না। সব কাস্টমারকেই জিনিস দেখাই।”
বলতে বলতে আমার বর এসে গেলো। বললো, এই কাছাকাছি একটা “ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট” লেখা রেস্টুরেন্ট পেয়েছি। কিন্তু সেটা বাংলাদেশি। এসেই জানতে চাইলো, উনি কে? আমি ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করলাম। পুরো গল্পটা বলার আগেই অবশ্য উনি “বাই” বলে চলে গেলেন।
  
২) অয়রোপা পার্ক, ২০০৫

আমরা দুজন গিয়েছিলাম ওই পার্কে বেড়াতে। সারাদিন টো টো করে ঘোরার পর, বিকেল চারটের সময় মনে হলো, নাঃ এবার বেরোতে হবে। না হলে বাড়ি পৌঁছতে পারবো না। পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা জায়গায় আমাকে দাঁড়াতে বলে, বর গেলো ফেরার বাস আর ট্রামের টাইম টেবিল দেখতে। খুব বেশি দূরে নয়, একটু দূরে। একা নিজের মনে দাঁড়িয়ে সারাদিন পার্কে বিভিন্ন রাইড চড়া, তার মজা, উত্তেজনা, রোলার কোস্টার দেখে ভিতু বরের চোখ-মুখের অবস্থার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন - “কোথায় থাকেন?”
প্রথমে উত্তর দেবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের ভারতীয় মানসিকতায় অচেনা লোক মানেই দুষ্টু, ধরে নিয়ে চলে যেতে পারে। তারপর ভাবলাম, নাঃ বলেই দি, কি আর হবে। একটু পরে ও তো চলে আসবে। সাহস করে বলে দিলাম।
তারপর আবার তিনি শুরু করলেন - “পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?”
“মনে হয় ঘন্টা চারেক।”
“সেকি? আপনি একাই আছেন?”
“না, আমার বর আর আমি।”
“তাহলে আপনাদের তো অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“না না, খুব রাত হবে না। আর এখানে রাত হলেই বা কি এমন ব্যাপার!”
“আমি মাঝামাঝি একটা জায়গায় থাকি। আমার বাড়ি পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। আপনারা চাইলে আমার বাড়িতে আজ যেতে পারেন।”
“মানে? আমাদের তো তাহলে আরো দেরি হবে ফিরতে।”
“না, মানে ফিরবেন কেন? আমি তো আমার বাড়িতে থাকার কথা বলছি।”
“মানে? আপনি আমাদের চেনেন না, জানেন না, আর এই অচেনা লোকদের আপনি থাকার কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে। আপনার সঙ্গে কথা বলে তো, চেনা হয়েই গেলো।”
“সত্যি আপনার এই অতিথি বৎসল মনোভাব দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আমরা এতোটা আতিথেয়তার কথা ভাবতে পারি না। আমাদের কলকাতায় তো একজন চেনা লোককেই বাড়িতে থাকার কথা বলতে দশবার ভাবে সবাই।”

সেদিন তিনি একেবারেই নাছোড়বান্দা। আমাদের নিয়েই যাবেন। আমি বললাম, “আপনি অপেক্ষা করুন। আমি তো একা নই, আমার বর কি বলে দেখি।” আমি মনে মনে জানি, কোনোভাবেই আমি কারো বাড়িতে থাকবো না, নিতান্ত কোনো ঝামেলা না হলে যত রাতই হোক ফিরে যাবো। কিন্তু বরের কথা বলে ওনাকে যাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে থামানো গেলো। এটা সেটা গল্প শুরু করলেন। কি করি, কতদিন আছি, কেমন লাগছে থাকতে….

বর এলো। সে এসেই তো অবাক! আমি এমন অনায়াসে কার সঙ্গে গল্প করছি। বললাম। তখন শুরু করলেন -
“দাদা আজ আমার বাসায় চলেন। আমার ওখানে কাটিয়ে কাল আপনারা ফিরবেন।”
হাসি হাসি মুখ করে, “না না তা আবার হয় নাকি। তার দরকার নেই, আমি বাস, ট্রামের সময়গুলো দেখে এলাম। আমরা এক্ষুণি একটা ট্রাম পাবো। আমাদের অসুবিধা হবে না।”
“না, মানে গেলে ভালোও লাগতো। অনেক গল্প হতো। এখানে তো আর তেমন করে বাঙালি পাই না। তাই দেখা হলে, গল্প হলে খুব ভালো লাগে।”
আমরা তাঁর অতিথি বৎসল মনোভাবকে অনেক সম্মান জানিয়ে, অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম। তিনি একটু মন খারাপের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

৩) সারব্রুকেন, ২০০৩
একদিন বিকেল। গাউস স্ট্রাসের সেই লম্বা মতো এক কামরা বাড়ি। খুব ফুরফুরে মেজাজে সাজগোজ করছিলাম। বর অফিসে। কাজকর্ম বলতে কিছু নেই। জার্মান ক্লাস তখনো শুরু হয়নি। সারাদিন একা। কলকাতা থেকে সবে সবে গেছি। তখনো কলকাতার গন্ধ গায়ে। বিয়ের গন্ধও। তাই শাড়িতে সাজ। হঠাৎ বেল বাজলো। ভাবলাম এতো তাড়াতাড়ি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এলো? হতেও পারে, নতুন এসেছি।
এই উটকো সময়ে বেল বাজলে দেখেছি, কিছু জার্মান মহিলা বাইবেল হাতে হাজির হতো। বাংলায় বাইবেল পড়া নিয়ে অনেক চাপাচাপি করতো। লম্বা ঘরটা পেরিয়ে ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে গেলাম। প্রথমে আইহোলে চোখ রাখলাম। পুরো অবতল - উত্তল লেন্স দিয়ে একটা অচেনা মুখ। এখনো এখানে যেমন ভয়ে ভয়ে দরজার একটুখানি অংশ খুলে, অল্প মুখ বাড়িয়ে দেখি কে এলো, সেদিনও তেমন করেছিলাম। দরজার একটু খুলতেই তিনি বাংলায় বললেন, “এটা কি দেবপ্রিয়র বাড়ি?”
“হুম! কেন বলুন তো? আমি তো আপনাকে ঠিক চিনি না…”
“আপনি আমাকে সিনবেন না। কাল আপনার হাসব্যান্ডের সঙ্গে বাসে আলাপ হইলো। আর আজ আমি এদিকেই আসতেসিলাম। এই কাসাকাসি আমার ভাই থাকে, তার কাসে আসতেসিলাম। তাই ভাবলাম একটু আপনাদের বাড়ি ঘুইরা যাই।”
“হুম! সে আপনি ভালোই ভেবেছেন, কিন্তু এখন আসতে হবে না। মানে সে যখন থাকবে তখন আসবেন।”
“তিনি কটায় ফেরেন?”
“এই রাত আটটা - নটা হবে।”
“ও তাহলে…”
“হ্যাঁ, আপনি এখন আসুন, সে এলে আসবেন। আর সে সকালে উঠে ইন্সটিটিউট যায়, রাতে ফেরে। আপনি সেই মতোই আসবেন।”

তাঁর তখনকার মুখের অবস্থা ঘুরে দেখার কথা ভাবিও নি।  

বর বাড়ি ফেরার পরে খুব চোটপাট করলাম -- “অজানা অচেনা একটা লোককে তুমি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছো?” সে অবাক, “বাড়ি কেনো পাঠাতে যাবো? আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে মাত্র।”

৪) বোলোঈন্যা, ২০১৬

বোলোঈন্যা যাওয়াই হয়েছিলো ছেলে আর তার বাবা ল্যাম্বর্গিনি এবং ফেরারি মিউজিয়াম দেখবে বলে। ল্যাম্বর্গিনি মিউজিয়াম দেখে বাসে ফিরছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের মতো দুজন লোক বাসে উঠলো। উঠেই আমাদের দিকে খুব করে দেখলো। তারপর আমার ডানপাশে একজন, আর তার পিছনের সিটে একজন বসলো। বসেই মোবাইলে স্কোর দেখা শুরু করলো। আমিও উঁকি দিয়ে দেখতে থাকলাম। বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ৬৯/৩, ৮৭/৪, ৯৫/৫...। পটাপট উইকেট পড়ছে। আর আমার পাশে বসা লোকটা আফসোস করে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বাংলাভাষা আমার কানে আসছে। আমার বর ইশারা করে বললো আজ খেলা আছে। আমি বললাম কাদের? বেড়াতে গিয়ে ক্রিকেটের খবর রাখা হয়নি আমাদের। আমাদের দুজনের কথায় তখন মোবাইল হাতে স্কোর দেখা লোক উঁ? বলে উঠলো। তখন আমি বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম - “কাদের খেলা হচ্ছে?”  তিনি বললেন “ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ।”  স্কোর টোর জেনে আমার বর বললো চিন্তা নেই, ভালো রান হয়েছে, আর পঞ্চাশ বাকি জিতে যাবে। আমি বললাম নানা পটাপট উইকেট পড়ছে। "হুঁ আগের ওভারেও পড়লো, এই ওভারেও", বলে মুখ কাঁচুমাচু করে বাই বলে ওরা নেমে গেলো।

হোটেলে ফিরে নেটে দেখলাম শেষ তিন বলে দু রান দরকার ছিলো, কিন্তু তিনটে উইকেট পড়ে গিয়ে বাংলাদেশ হেরে গেছে।

সেদিন ওদের দুজনের কথা ভেবে খারাপ লাগছিলো। আসলে বাংলাদেশকে অন্যদেশ ভাবতে কেমন একটা লাগে। কিছুদিন আগে খেলা দেখতে দেখতে রুহান আমাকে প্রশ্ন করেছিলো, “মা, ওরা তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলে, আমাদের ভাষাও তো বাংলা। তাহলে ওদের দেশ কেনো বাংলাদেশ, আমাদের কেনো ইন্ডিয়া?” রুহানের বয়স তখন চার বছর দু মাস!

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত