সবজিওলা

বাঘাযতীন মোড় থেকে স্টেশনের দিকে একটু এগিয়ে ময়ূরী বেডিং স্টোর্স। ঠিক তার ডানদিকে বাড়ির দরজায় লেখা ১৬১। দরজার বাইরের একফালি সিমেন্টের মেঝে। সেই মেঝেতে খুব বুড়ো এক দাদু কিছু সবজি নিয়ে বসেন। দেশি শশা, দেশি পটল, কাঁচালঙ্কা, পাতিলেবু, আমলকির সময় আমলকি, আর অন্য সময় কিছু ছাড়ানো বীজ। প্রতি শুক্রবার আমি ফেরার সময় দাদুর থেকে ১০০ টাকার জিনিস কিনি। দরকার না থাকলেও।


দাদুর সাদা ধবধবে চুল, দাড়িও। কথায় একটু হিন্দিভাষী টান আছে। একদিন আমার সঙ্গে টানা হিন্দি বলতে শুরু করেছিলেন। আমার হিন্দির দৌড়ের মাত্রা বুঝে ভয় পেয়ে বলেছিলাম, “হিন্দি বলছেন কেনো? আমি তো বাংলা বুঝি।” তখন তিনি বলেছিলেন, “হিন্দিও বলতে পারি, বাংলাও বলতে পারি।”


একদিন দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ি কোথায়?”
বললেন, “এই কাছাকাছি।”
“কে দিয়ে যায় এই সবজিগুলো?”
-- “কেউ না, একাই আনি।”
বলেই বললেন, “আপনি সপ্তাহে এই রাস্তায় একদিন আসেন তাই না?”
বললাম, “দুদিন আসি। একদিন সকালে, তাই আপনাকে দেখতে পাই না।”
বললেন, “হ্যাঁ আমি সকালে আসি না।”
আমি আবার জানতে চাইলাম, “এতো সবজি আনেন কি করে?”
-- “রিক্সায়।”
“একাই?”
-- “হ্যাঁ।”
“ও, আমি ভেবেছিলাম ছেলেরা দিয়ে যায়, আপনি বসে বসে বিক্রি করেন।”
-- “না না আমি একাই আনি।”
“বাড়িতে কে আছে?”
-- “বুড়ি আছে।”
দাদুর মুখে “বুড়ি” নামটা শুনতে আমার ভীষণ মিষ্টি লাগছিলো।
জানতে চাইলাম, “ছেলে নেই?”
-- “আছে। তারা নিজের নিজের মতন থাকে।”
“কজন ছেলে?”
-- “দুজন।”
“কে রান্না করে দেয়?”
-- “ছেলেদের?”
“না, আপনার।”
-- “বুড়িই রান্না করে। বুড়ির এখন চোখ খারাপ, ব্যাঙ্গালোর গেছে চোখ দেখাতে।”
“তাহলে কে রান্না করছে?”
-- “কেউ না।”
“কোথায় খাচ্ছেন?”
-- “হোটেলে। আমার খুব কষ্ট।”
“হুম বুঝতে পারছি।”
-- “আমার একবার ইস্টোক হয়ে গেছে।” বাঁহাতটা দেখিয়ে বললেন “এটায় তো কিছু করতে পারি না।”
আঙুলগুলো সব বেঁকে গেছে দেখে বললাম, “কি করে এমন হলো?”
-- “ইস্টোক হয়ে। ইস্টোক হলে তো এমন হয়। আমার বাঁদিকটা পুরো ঝিনঝিন করে। কিচ্ছু কাজ করতে পারি না। আমার খুব কষ্ট।”
“সকালে কোথায় থাকেন?”
-- “সকালে ওই একটা বাজারে অল্প অল্প জিনিস নিয়ে বসি। একেবারে বসে থাকবো কেন, তাই যা হয়।”
“আপনার আয় কতটা হয়?”
দাদু কোনো সংখ্যা বলতে পারলেন না। “আমার আর আয় কত হবে, এই তো কটা জিনিস নিয়ে বসি।”


সব মিলিয়ে হয়তো কেজি পাঁচেক জিনিস হবে। সব সবজির কোয়ালিটি এতো ভালো, আমি তাই না কিনে ফিরি না। তার থেকেও বেশি দাদুর উপর আমার একটু মায়া পড়ে গেছে। কোনো শুক্রবার যদি যেতে না পারি, মনে মনে খুব দুঃখ হয়।


দাদু আবার বললেন, “আমার খুব কষ্ট।”
“বুঝতে পারছি। আজ অনেক রাত হলো। দাদু পরের শুক্রবার আমি শুনবো। বলবেন তো?”
-- “হুম বলবো।”
“ঠিক আছে আজ আসি।”


পরের শুক্রবার বাঘাযতীনে আমার কাজে গেছিলাম। ঠিক যে গলিটা দিয়ে আমি ঢুকি হঠাৎ দেখি দাদু সেই গলি দিয়েই বেরোচ্ছেন। ডানদিকের কাঁধে সবজির পোঁটলা। আমাকে দেখেই চিনতে পেরে, একগাল হেসে বললেন, “আজ এসেছো?” বললাম, “হ্যাঁ, যাওয়ার সময় দেখা হবে।” দাদু বললেন, “আচ্ছা।”


ফেরার সময় দাদুর সবজির কাছে এলাম। এসেই বললাম, “দাদু আগেরদিন শশাগুলো তেতো ছিলো।”
-- “থাকতে পারে, বৃষ্টি ফিস্টি হচ্ছে না তো!”
“ও, বৃষ্টি না হলে তেতো হয়?”
-- “হ্যাঁ।”
“আজ বেশি চাই না ৫০০ শশা দিন। বাড়িতে কে আছে আজ?”
-- “কেউ নেই তো! বুড়ি তো এখনো ফেরেনি। ছোটছেলে এলে তবে আসতে পারবে।”
“ছোটছেলে নিয়ে গেছে?”
-- “হ্যাঁ, ছোটছেলে ওখানেই থাকে। সে দিতে এলে তবে আসতে পারবে।”
“তাহলে আজ রান্না?”
-- “আমি এখন টানা হোটেলেই তো খাচ্ছি। চার মাস হয়ে গেলো! দুপুরে ভাত, রাতে রুটি।”
“কত শশা তুলছেন? ৫০০ হয়নি?”
-- “এক কেজিই নিয়ে নাও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে দিয়ে দিন। টানা হোটেলে খাচ্ছেন, শরীর খারাপ হবে তো!”
-- “হচ্ছে তো! গ্যাস হয়ে যায়, ওষুধের ওপরেই থাকি। আমার খুব কষ্ট।”
“হুম! বলেছিলেন, আজ বলবেন।”
-- “এই হসপিটাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হসপিটাল।”
“আবার কার কি হলো? হসপিটাল কেন? হসপিটাল কোথায়?”
-- “এই তো বাঘাযতীন হসপিটাল। আমারই তো হয়েছে। আমি তো ইস্টোক রুগি। এই যে দেখো না আমার পুরো বাঁদিকটা অকেজো।” বলে বাঁদিক দেখালেন। “প্রতি শুক্রবার আমি হাসপাতালে যাই।”


সবজি দাঁড়িপাল্লায় তোলা থেকে ওজন, সবটাই ডানহাত দিয়ে করেন, তাই একটু বেশি সময় লাগে।


“হাসপাতাল গেলেই ওষুধ দিয়ে দেয়? নাকি লাইন দিতে হয়?”
-- “লাইন দিতে হয়। সেই দশটায় আসি, ফিরতে দুটো বেজে যায়। সেদিন আর বেরোই না।”
“এই তো আজ বেরিয়েছেন, আজ শুক্রবার।”
-- “আজ হাসপাতালে যাইনি।”
“হাসপাতালে কি বিনা পয়সায় ওষুধ দেয়? নাকি পয়সা লাগে?”
-- “পয়সাও লাগে, বিনা পয়সাও লাগে”। বলেই হাসি।
-- “লঙ্কা লাগবে?”
“দিয়ে দিন অল্প। মোট একশো টাকা করে দিন।”
-- “শুধু শুক্রবার আসো তাই না?”
“হুম, শুক্রবার সন্ধ্যে। আপনি তো সকালে বসেন না!”
-- “সকালে আমি ইস্টিশনের বাজারে বসি।”
“এগুলো সব বিক্রি হয়ে যায়?”
-- “কোনো কোনো দিন হয়, কোনো দিন হয় না।”
“যেগুলো রয়ে যায় কি করেন?”
-- “পরেরদিন সকালে বাজারে বেচে দি। আমার খুব কষ্ট। সেই ছোট থেকে করে যাচ্ছি, আজও কষ্টই চলছে।”
“ছোট থেকে কি করেছেন?”
-- “পড়াশুনো করিনি। স্কুল ছুট হলাম।”
“পড়াশুনো কতটা করেছেন?”
-- “ক্লাস সিক্স অব্দি। বাবা বলেছিলো সিক্সে ফেল করলে বাড়ি না ঢুকতে। আমি জানতাম ফেল করবো তাই আর বাড়ি ঢুকিনি। সোজা বম্বে চলে গেছিলাম।”
“তারপর?”
-- “তারপর ওখানে কোনো কাজ পাইনি, তখন হাবড়ার ট্রেন দেখলাম। কাছে একটাও পয়সা নেই, তাও উঠে পড়েছি।”
“হাওড়া?”
-- “হ্যাঁ হাওড়া।”
“তারপর কি কলকাতা এলেন?”
-- “হ্যাঁ কলকাতা এলাম।”
“তারপর?”
-- “তারপর চায়ের দোকান, হোটেল এইসব করে কাজ জোগাড় করলাম। আর দেশে ফিরিনি।”
“দেশ কোথায়?”
-- “দেশ উত্তরপ্রদেশ। বাড়ির লোক খুব খোঁজাখুঁজি করেছিলো। তখন আমি বাড়িতে একটাই ছেলে। বাবারা চারভাই। শুধু বাবার বিয়ে হয়েছিলো, কাকাদের হয়নি। কাকারাও আমাকে খুব খুঁজেছিলো। আমি বাথরুমে লুকিয়ে ছিটকিনি আটকে বসেছিলাম। খুঁজে পায়নি।”


সেটা কোথাকার বাথরুম আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। পাশে একজন লোক বসেছিলেন, তিনি হঠাৎ বললেন, “ইচ্ছে করে ফেল করেছিলে নাকি?” বলতে বলতেই তাঁরও খদ্দের এসে গেলো। আমি বললাম, “দাদু, পরের শুক্রবার বাকিটা শুনবো। মনে রাখবেন কলকাতা অব্দি আসা হয়েছে।” তিনি বললেন, “আচ্ছা।”



সবজি কেনা আর গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে দাদুর কিছু ছবি তুললাম। দাদু বেশ pose দিলেন। আমি বললাম, “দাদু, একটু হাসতে হতো, এটা রাগিরাগি ছবি হয়ে গেছে।”


পাশে বসা লোকটা আবার ফুট কেটে বললেন, “বুড়োরা রাগিই হয়।”

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত