কুলকুলতির ব্রত

মেয়েদের ছোটবেলা মানেই মা বা ঠাকুমার শাড়ি। মাথায় গামছা বা ওড়না দিয়ে লম্বা চুল কিংবা খোঁপা। পুতুলের মা সাজা কিংবা নাচের দিদিমণি। অথবা স্কুলের।


আমরাও ছিলাম কয়েকজন। মা, ছোটঠাকুমা বা মেজমার শাড়ি পরে, গামছা দিয়ে চুলের বেণি করে দিব্যি নাচতাম, পুতুল খেলতাম, রেলিংগুলোকে ছাত্র সাজিয়ে বিজ্ঞের মতো পড়া কম-বেশি সবাই বুঝিয়েছি। আমার ঠাকুমা থান পরতো তাই তার শাড়ি পরতে দিতো না। এই শাড়ি পরাটাই ছিলো খুব লোভনীয় ব্যাপার। তার জন্যে অনেকেই সন্ধ্যে দিতে, কুলকুলতির ব্রত করতে ভালোবাসতো। আজকাল শাড়িরা বন্দী ন্যাপথলিনে। ব্রতেরাও বিলীন।


শাড়ি পরে পরিপাটি হয়ে সন্ধ্যে দেওয়া, কুলকুলতি করা বেশ পছন্দের কাজ ছিলো। কার্তিক মাসের পয়লা থেকে কুলকুলতির পুজো করতে হতো। টানা একমাস পুজো করে মাসের শেষ দিনে ভোরবেলা জলে ভাসিয়ে চান করতে হতো। একবার করলে পরপর তিনবছর বা পাঁচবছর করতে হতো।


পুজোর জন্যে রোজ তিনটে করে প্রদীপ, ফুল, কুলপাতা, দূর্বা লাগতো। একমাস রোজ বিকেলে ঘুরে ঘুরে সবার বাগান  ফুল তোলাটা তখন একটা জরুরি কাজ। এই পুজোয় কুলপাতা অবশ্যই দিতে হতো। তাই বাড়ির কাছের কুলগাছ বলতে তখন চৌধুরীদের কুলগাছ। কেউ কেউ কুলপাতা তুলতে গিয়ে চৌধুরী-দাদুর বকাও খেতো। যারা দুষ্টুমি করে গাছে লাঠির বাড়ি দিয়ে অনেক পাতা ঝড়িয়ে দিতো, দাদু তাদেরই বকতো। কুলপাতা লাগতো বলেই মনে হয় এর নাম কুলকুলতি। কুলে বাতি দেওয়াও বটে, তবে মেয়েদেরই পুজো এটা।


ফুলটাও মোটামুটি চুরি করে, লুকিয়েই জোগাড় করতে হতো। পাড়ার প্রায় সব মেয়েই এই পুজোটা করতো, তাই গাছে ফুল দেখতে পাওয়া একটা মুশকিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো। কে কতটা ফুল তুলে তার সাজি আগে আগে ভরিয়ে ফেলতে পারে, সেটা নিয়ে একটা গুপ্ত প্রতিযোগিতা আর সুপ্ত আনন্দ সবার মুখেই ফুটে উঠতো। ফুল তোলার সময়েও অনেকে গামছাকে শাড়ির মতো করে পরতো।


প্রদীপটা সবাই কাদামাটি দিয়ে বানিয়ে শুকিয়ে নিতো। বাজার থেকে কিনতো না। কিনলেও ওই শেষ দিনের জন্যে কিনতো। একমাসের প্রদীপ কে কত আগে বানিয়ে নিতে পারে তাই নিয়েও ছিলো একটা উত্তেজনা। একে অপরকে জিজ্ঞেস করতো - “তোর কটা প্রদীপ হয়েছে? আমার এতোগুলো, শুকিয়েও গেছে সব।”  বলার মধ্যে বেশ একটা গর্ব থাকতো। জিততে পারলে তো আনন্দের শেষ নেই।  


রোজ সন্ধ্যেবেলা তুলসী তলায় পুজোটা করতে হতো। এর অনেক আলাদা আলাদা মন্ত্র। জল তোলার, প্রদীপ জ্বালানোর, পুজোর, গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার আবার শাঁখ বাজানোর। এতোগুলো ধাপে পুজো শেষ হতো। তুলসীর বেদীদে প্রথমে তিনটে কুলপাতা, তার ওপর তিনটে দূর্বা দিয়ে তিনটে প্রদীপ তেল সলতে দিয়ে সাজিয়ে বসাতে হতো। তারপর একটা একটা করে তুলে মন্ত্র বলে জ্বালাতে হতো। প্রথমে পুকুর ঘাট থেকে জল আনতে হয়।


এই সময় অনেকের বাড়িতে আর একটা রীতি পালন করতে দেখেছি - স্বর্গে বাতি দেওয়া। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে শুভ কামনায় বাতি। মাটিতে একটা বাঁশ পুঁতে দড়ি বেঁধে ঠিক পতাকা তোলার মতো করে একটা লণ্ঠন রোজ সন্ধ্যেবেলা তুলে দেওয়া। আবার সকালবেলা নামিয়ে নেওয়া। শুধু কার্তিক মাস। এইভাবে শুভকামনা যদি করাই যায়, তাহলে কেন শুধু একমাস আমি জানি না। তবে এখন আর এটাও কেউ করে বলে মনে হয় না, কারণ লণ্ঠনই তো নেই আর।


কুলকুলতির বিভিন্ন মন্ত্রগুলো স্মৃতি থেকে দিলাম।


জল নেওয়ার মন্ত্র

জলে আছে জলকুমারী,
ডাঙায় আছে হরি,
এক ঘটী জল দাও মা,
হরি পূজা করি।

প্রদীপ জ্বালানোর মন্ত্র
সাঁঝ সলতে পরমবাতি,
সন্ধ্যে দেখায় ভগবতী,
কোথায় আছে দেবগণ,
সন্ধ্যে দেখায় নারায়ণ।

পুজোর মন্ত্র

কুলকুলতি কুলের বাতি,
তোমার তলায় দিয়ে বাতি,
অরণ ঠাকুর বরণে,
ফুল ফুটেছে চরণে।
এ ফুলটি যে তুলবে,
সাত ভাইয়ের বংশে,
সাবিত্রী সত্যবান।
কার্তিক মাসে রাসে,
ধুপ ধুনো বাসে,
ধুপ, দীপায় নমঃ

তুলসী গাছে জল ঢালার মন্ত্র

তুলসী তুলসী মাধবলতা,
ও তুলসী কৃষ্ণ কোথা?
কৃষ্ণ গেছে গোচারণে।
তোমার শিরে ঢালি জল,
অন্তর থেকে দিও স্থল।

শাঁখ বাজানোর মন্ত্র

শাঁখে আছে শঙ্খধ্বনি,
শাঁখ বাজায় মহামুনি।


ছোট্ট মেয়েরা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এইভাবে পুজো করার পর, মাসের শেষ দিনে ভোগ দিতো। সেটা বেশ খুশির দিন। ভোগ তৈরি হতো চিঁড়ে, দুধ, কলা, বাতাসা দিয়ে। সঙ্গে থাকতো অন্যান্য ফল, আলাদা থালায়। রোজকার মতো ওইদিনও পুজো করে নিতে হতো সন্ধ্যেবেলা। কিন্তু ভাসানোটা ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে। তখন তাদের বেশ কান্না পেতো। দুটো কারণ, এক - পুজো শেষ তাই মন খারাপ, দুই - ওই ভোরে ঠাণ্ডায় চান করা।


প্রদীপ ভাসানোর জন্যে কলার ভেলা তৈরি করতে হতো। কলার ভেলায় আবার প্রদীপ আর মোমবাতি ওই ভাবেই কুলপাতা, দুর্বা, অনেক ফুল দিয়ে সাজিয়ে আর একবার পুজো করতে হতো। যারা একই পুকুরে ভাসাতো তারা আবার  একজায়গায় জুটে গল্প করতো। কার প্রদীপ কতক্ষণ অব্দি জ্বলে, কারটা আগে আগে নিভে গেলো? যার প্রদীপ যত বেশিক্ষণ জ্বলতো তার চোখ মুখও ঠিক ততক্ষণই থাকতো প্রদীপের শিখার মতো উজ্জ্বল।


তারপর আসতো চানের পালা। যে শীতকে অগ্রাহ্য করে ঝপাং করে জ্বলে পড়ে যেতো পারতো, সে-ই সেরা। সবাই সবসময় চান করতো না। যারা করতো না তারা পরেরদিন সকালের আলোচলার পাত্রী হয়ে উঠতো। তাই নিয়ে একটু আধটু চাপা রাগ, মুখ ব্যাঁকানো থাকতো বটে তবে আহামরি কিছু ঘটতো না। ধীরে ধীরে অনেকেই ঠাণ্ডার জন্যে চান করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।


এখন তো পুরো পুজোই বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমার বাড়ির কচিকাঁচাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা এই পুজো করে কিনা। জানা গেলো তারা করে না, এমনকি নামটাও আগে কখনো শোনেনি। পাড়ার কেউ করে কিনা চানতে চেয়েও “না” উত্তরটাই পেলাম। তারা বললো আমরা তোমার কাছেই নাম শুনছি, আমাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এখন কেউ এটা করে না।

কার্তিকমাসের রোজ সন্ধ্যেবেলায়, 
ছোট্টমেয়ে প্রদীপ নিয়ে তুলসীতলায় --
ঘেঁটুর মতোই অতীত।


Comments

Popular posts from this blog

সবজিওয়ালা - ২

অন্ধকারের উৎস হতে