মহিলা কামরা - ৫

ঠান্ডা পড়েছে। রঙবেরঙের শাল সোয়েটারে মোড়া মহিলা কামরা। উলের লম্বা কুর্তিও দেখা যাচ্ছে দু একটা। এই তো আজ বাদে কাল স্কুল কলেজ হয়ে এক সপ্তাহের জন্যে নিশ্চিন্ত। ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গল্পেরা ছুটে চলেছে নৈনিতাল থেকে গ্যাংটক। মাইনাস সতেরো ডিগ্রি থেকে মাইনাস দশ। গল্পেরাও পায় উষ্ণতা। যেমন মোয়ারা পাচ্ছে আদিখ্যেতা। বন্ধ জানলার কাঁচ। তাই ভানুদাকে অনেক ডেকেও সিটি গোল্ডের গয়নার গ্যারান্টি পিরিয়ডটা লিখিয়ে নেওয়া গেলো না। হতাশ গলা — “উফ! আবার সেই কতদিন পরে আসা, মনে থাকবে তো ভানুদার!”

এর মধ্যেই একটা বড় সমস্যা! না সমস্যা ঠিক নয়, কারণ ওরাই সমস্যা দূর করে। বলা ভালো একটা সম্পর্কের টানাপোড়েন। দু-তরফের। শহরে। এখন গ্রামেও। আগেও ছিলো, এখনো আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। 

এক দিদিমণি তাঁর সমস্যার কথা শুরু করলেন। বাড়িতে  ছোট বাচ্চা আছে। মূলত তাকে দেখার জন্যেই সবসময়ের জন্যে একজন লোক রেখেছেন। বাড়িতে দিদিমণির মা থাকেন, তিনিই প্রায় সবকিছু করেন। সুবিধার জন্যে একজন লোক রাখা হয়েছে। 

দিদিমণি বেশ শান্ত গলায় সমস্যাগুলো বলতে থাকলেন। অন্য এক দিদিমণি বেশ জোর গলায় অনেক পরামর্শ দিতে থাকলেন। 

সেই কাজের মেয়ের মাছ ছাড়া খাবার মুখে রোচে না। বলেছে — “তোমরা নিজেরা মাছ না খাও আমার জন্যে বরফের মাছ এনে রাখবে। আমি খাবো। তোমরা যে কি মাছ খাও? শুধু রুই আর কাতলা! কেনো? পার্শে, পাবদা কি বাজারে পাওয়া যায় না?”

দিদিমণি বলেছেন — “না যায় না। তুমি কিনে এনো।” এই কথা শুনে অন্য অন্য দিদিমণি টিপ্পনী কাটলেন — “আহা! বাড়িতে যেন রোজ ইলিশ খান!” 

কাজের মেয়ের কর্ত্রী দিদিমণি অন্য দুই দিদিমণিকে বোঝাতে লাগলেন যে তাঁর এমনিতেই মাছ খাওয়া নিষেধ, ডাক্তার বারণ করেছে। টানের কষ্টের জন্যে। আর ভালোও লাগে না। বর এখন নেই তো। বাবুর জন্যে একটু মৌরলা ভাজা করলেই তার হয়ে যায়। একদিন তিনি আর তাঁর মা ভেবেছিলেন দুজনেরই ষষ্ঠীর ব্রত, রাঁধবেন না, মুড়ি ছোলাভাজি খেয়ে কাটিয়ে দেবেন।

তাতে কাজের মেয়ে বলেছে — “আমি থাকতে পারবো না। আমি রুটি করে নেবো।” 

মা বলেছিলেন — “কেনো? তুমি তো রোজ রাতে বাড়িতে মুড়ি খেয়েই থাকো?”

— “রাতে পারি, সকালে পারবো না।” বলেই বাবুর রুটি করার সময় তিনখানা রুটি করে নিয়েছিলো। একটা বাবুর। দুটো তার নিজের। দিদিমণি  আর তাঁর মা মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছিলেন। 

পাশের দিদিমণি বললেন — “শোন? একদম বলে দিবি, যে আমাদের বাড়িতে থাকতে হলে আমাদের মতোই থাকতে হবে। আমরা যা খাই তাই খেতে হবে।” 

— “মা, আমি, বলি তো। কিন্তু আজকাল মুখে মুখে কথার উত্তর দেয়।” 
— “শোন এইভাবে বলবি - বলবি আমি একটা লোক ঠিক করে রেখেছি, তুমি আমার কথা শুনে চলবে নাকি বলো, না হলে তাকে রাখবো। আসলে ও তোকে ব্ল্যাকমেল করে। ভাবে এরা চাকরি করে এদের লোক না হলে চলবে না। তাই এমন করে। তুইও এইভাবে অন্য লোকের কথা বলে ব্ল্যাকমেল করবি।”

— “আরে সেদিন কি করেছে জানো? আমি দুটো কুর্তি গোছাতে দিয়েছি। যাহোক তাহোক একটা ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে। আমি দেখিয়ে বললাম এটা তোমার কি ভাঁজ হয়েছে? বললো — ‘এমনই আমি পারি এর থেকে ভালো পারিনা।’ আমি বললাম — ‘পারো না যখন বলতে পারতে, বৌদি একটু দেখিয়ে দাও? আমি এসে দেখিয়ে দিতাম।’ সঙ্গে সঙ্গে মুখের ওপর বললো — ‘সকালবেলা তোমাকেই বা এতো ফিরিস্তি দিতে হবে কেন?’ বললাম — ‘তুমি কি আমার শাশুড়ি নাকি? তুমি আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছো?’ 

— “বারবার বলছি শোন, ওকে বল। না হলে তুই মিছিমিছি এই কাজের লোক নিয়ে টেনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়বি।” 

— “এই তো দেখো না - আমি এখান থেকে ফিরবো সে চেয়ারে বসে থাকবে। আমি বাবুকে জামা পরাবো, পাউডার মাখাবো, ফ্রেশ করাবো সে চেয়ারে বসে থাকবে। তারপর আমি চাবি আর সাইকেল হাতে দেবো, তবে আমার বাবু সাইকেল চালাতে যাবে। সে তার পিছু পিছু যাবে। আবার ফেরার পর আমি জামা-প্যান্ট ছাড়িয়ে ডেটল দিয়ে হাত পা ধোয়াবো, সে বসে থাকবে। সকালে তাও মা সব করে। চান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো। আর ওনার শুধু মুখে বড় বড় কথা। — ‘তোমাদের তরকারি আমি খেতে পারি না, প্রেসারের ভাত - ওই দলা দলা ভাত আমি খাই না। তোমাদের কত গ্যাস বাঁচে গো? একটু ফ্যান গেলে ভাত করলে কি হয়?’ আমি বলি বাঁচে।”

অন্য দিদিমণি — “না না এমন বলবি না। বলবি কি বাঁচে না বাঁচে সে আমি বুঝবো। তোমাকে এতো ভাবতে হবে না।” 

— “একদিন দেখি এতো উচ্ছে কেটে রেখে দিয়েছে। বললাম - ‘উচ্ছে কি হবে?’ বললো - ‘ভাজা’। ‘কে খাবে? আমি বা মা কেউই তো খাই না।’ ‘আমি খাই।’ বললাম - ‘এমন তুমি খাও বলেই চলবে না। আমরা খেলে করবে।’ ‘কেনো? ভাজবো তো দু ফোঁটা মোটে তেল দিয়ে। তাতে কি এমন হয়ে যাবে?’ ” 

বলতে বলতেই খেওয়াল হলো রাজকুমার এসেছে। কথা থামিয়ে বললেন — “এই রাজকুমার পেয়ারা দিও।”
অন্য দিদিমণিও বললেন — “ও! রাজকুমার এসেছে? রাজকুমার পেয়ারা দিও।” 

বলেই উনি বাড়িতে  কারো কাছে ফোন করে বলতে লাগলেন — “দিদিভাই উঠেছে? দিদিভাই? শোনো দুটো ডিম সিদ্ধ আছে। একটা সে উঠলে দিও। আর একটা? আর একটা তুমি খেয়ে নিও, এখন বা দুপুরে। সে উঠেছে?” 

উত্তর পেলেন কিনা জানি না। ফোন রেখে দিয়ে ‘রাজকুমার রাজকুমার’ করতে লাগলেন।

আর ওই দিদিমণি  তখন তাঁর বাঁ পাশের জনকে বলতে লাগলেন — “আগের মেয়েটা ছিলো ভালো। সে বাবুকে যত্ন করে, গল্প করে খাওয়াতো। মুখের উপর এতো কথা বলতো না। এই দময়ন্তীটাই যেন কেমন! ওর জন্যেই আমার কদিন বেশ টেনশন করে কাটছে।  বাজার যাবার লোকের অসুবিধা, আমার বর বাড়িতে নেই, এখন বাইরে গেছে। আর ও না থাকলে আমরা এমনিই একটু রান্নাবান্না কম করে, মা মেয়ে যাহোক একটা করে চালিয়ে দি। মায়ের তো এখন আবার অশৌচ চলছে। সেই বাবা তিনটে নাগাদ ফোন করলে, ওদিকের নিয়ম কানুন হলে মা তবে ভাত খায়। মায়ের তো এখন সব সিদ্দসিদ্দ খাবার!” 

এরমধ্যে পিন্টু হাঁকতে হাঁকতে চলে গেলো — “জলের দামে পাবেন ফলের রস। দশ টাকায় পাঁচটা হয় ছটা পাচ্ছেন। এক কাপ চায়ের দামই পাঁচ টাকা। এই লেবু কমলা দশটাকায় ছটা। লাস্ট ঝুড়ি। এই ট্রেনেই আমি বাড়ি চলে যাবো।”

আর এক দিদিমণি একটু এগিয়ে এসে ওই টপিকেই যোগ দিলেন — “আমিও আমার মেটারনেটি লিভ শেষ হওয়ার আগে একজনকে ঠিক করলাম ছেলের জন্যে। ভাবলাম মা তো থাকেই, তার সঙ্গে একজন থাকলে মায়ের একার উপর চাপ পড়ে না। কিন্তু সে এক মহিলা, বাচ্চার থেকে আমার আর আমার বরের যত্ন করতে থাকলো। আমাদের খেতে দেওয়া, জল দেওয়া। সবজি কেটে দেওয়া। তারপর দুপুরে ভাত খেয়ে ভোঁসভোঁস করে একটা ঘুম দিতো। মা বলতো তুমি বাচ্চাকে কখন দেখছো? বাচ্চার তো কিছুই করো না। বাচ্চাও তেমনি, তার কাছে খেতেও চাইতো না, থাকতেও না। তার নাম শিউলি। কিন্তু তার গায়ে এতো গন্ধ যে সারা ঘর গন্ধ হয়ে থাকতো।”

অন্য দিদিমণিরা বললো — “তুমি কিছু বলতে না?”

— “বলবো কি, তাকে সাবান, শ্যাম্পু সব দিয়েছিলাম। এসে ফ্রেশ হয়ে বাচ্চার কাছে থাকার জন্যে। কিন্তু সে যেটা করতো এসেই শাড়িটুকু চেঞ্জ করতো। বাড়ি যাওয়ার সময় সাবান, টাবান মেখে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি যেতো। পরেরদিন আবার জাস্ট এমনি চলে আসতো।”

— “সুবিধা হচ্ছে না দেখে অন্য একটা আয়া সেন্টারে ফোন করলাম। সেই সেন্টারের মহিলা শিউলিদির কথা শুনে বললো — ‘কোনো কোনো মহিলার গায়ে অমন গন্ধ হয়। যাদের মকর রাশি হয় তাদের কাছে টেকা যায় না। ঠিক আছে আমি আপনার জন্যে একটা ভালো মেয়ে পাঠাবো।’”  

— “পাঠালো?” 

— “হ্যাঁ, পরেরদিন একজনকে পাঠালো। একটু অল্প বয়সি, বিবাহিত তার একটা ছ বছরের মেয়েও ছিলো। ভাবলাম এ তাহলে একটু ভালো দেখাশুনো করতে পারবে। নিজের মেয়ে আছে। শিউলিদিরও ছেলে, তবে সে অনেক বড়। তখনই বলেছিলো ইলেভেনে পড়ে। এ মেয়েটার নাম রত্না। রোগাসোগা। কিন্তু খুব চতুর। সেটা পরে বুঝেছি আমরা। প্রথম দিনেই তো ছেলের হাতের নখ কাটতে গিয়ে কাঁচা মাংস বের করে দিয়েছিলো, ছেলের কি কান্না।”

— “সেকি! তুমি কিছু বলোনি?” 

— “না, সেদিন কিছু বলিনি, ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। তারপর দেখলাম সে ছেলেকে বাইরে নিয়ে যেতো যখন ছেলের দিকে নজর না দিয়ে বাইরের লোকের সঙ্গে গল্প করতো। ছেলের দুটো পায়ে মশা কামড়ে ফুলিয়ে দিতো তার কোনো হুঁশ থাকতো না।” 

— “তারপর কি করলে ছাড়িয়ে দিলে?” 

— “আরে ছাড়িয়ে দিই নি। সে এক ঘটনা। একদিন আমার পিসি শাশুড়ি এসেছিলো। ব্যাগে দুহাজার টাকা রেখেছিলো। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি ফেরার সময় দেখে ব্যাগের টাকা হাওয়া। তারপর রত্নাকে জিজ্ঞেস করা হলো - সে বললো পিসি যা ঘুমোয়, ওনার তো কোনো হুঁস থাকে না। খুব হেসে হেসে বলেছিলো। তারপর আমার মা আবিষ্কার করলো সারা মাসের এনে রাখা মশলার মধ্যে পোস্ত থেকে শুরু করে একের পর এক প্যাকেট মিসিং। সেদিন ছিলো মাসের শেষ। ফলে তাকে আমরা মাইনেও দিয়ে দিয়েছি। পরের দিন থেকে দেখি সে আর আসে না।”
 
— “তা তুমি তো সেন্টার থেকে নিয়েছো তাদের কিছু বলোনি?”  
— “দুদিন আসেনি দেখে ফোন করলাম। তখন তারা বলছে, ‘আপনি প্রথম দিনেই কেন কিছু বলেননি? যখন নখ কাটতে গিয়ে অমন করলো। এখন আর কি বলি বলুন তো! আপনিও তো বলছেন কোনো প্রমাণ নেই।’ আমি  তখন বললাম - ‘হ্যাঁ আমার বাড়ির জন্যে ওকে কিছু বলার দরকার নেই, জাস্ট আর পাঠাতে হবে না। কিন্তু আপনি মাথায় রাখবেন ওকে যখন আবার অন্য বাড়িতে পাঠাবেন ওর এইদিকগুলো খেয়াল করবেন। সেটা বলার জন্যেই আমি আরো ফোন করেছি।’ সে তখন বললো, ‘হ্যাঁ থ্যাংক ইউ, এবং সরি ও এগুলো করার জন্যে। এই মূহুর্তে আমার হাতে আর কেউ নেই। থাকলে আপনাকে একজন ভালো মেয়ে দিতাম।’ আমি বলেছিলাম - ‘না না সে ঠিক আছে। আমি অন্য মেয়ে খুঁজে নেবো।’ দূর! নমস্কার! আর আমি মেয়ে রাখিনি। ওই মা-ই একাই সামলেছে।” 

এবার সবাই বলতে শুরু করলো — “সবার আয়া ভাগ্য সমান হয় না গো। কেউ কেউ আছে খুব ভালো। কেউ কেউ আছে বাচ্চাকে ধরে মারে, তার খাবার খেয়ে নেয় কতরকম সব শুনি।” এই দিদিমণি আবার বললেন — “আরে আমার এক কলিগেরই বাচ্চার আয়া তো খুব ভালো। সেই হওয়া থেকে রেখেছে। তারা তো দুজনেই বেরিয়ে যায়। খুব ভালো ওর আয়া। স্কুলে দেওয়া নেওয়াও সে করতো। তারপর তার পড়ে গিয়ে হাত ভাঙলো ব্যাস, ওর খুব অসুবিধা হয় এখন। এখন সে বাচ্চাকে পুলকারে দিয়েছে। পুলকার ক্রেশে পৌঁছে দেয়, আমার কলিগ ফেরার পথে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি যায়।”

ট্রেন থেকে নামতে নামতে ভাবলাম, এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের যে টানাপোড়েন — তার একটা দিক আজ শুনলাম। অন্যদিকের কথা অন্যদিনের জন্যে রইলো। 

Comments

Popular posts from this blog

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত

অন্ধকারের উৎস হতে