লক্ষ্মী ও সরস্বতী

যাদবপুর স্টেশন। যাবো বারুইপুর। সামনের মহিলা কামরা। অনেক ভিড় দেখে এক অল্প বয়সী সুন্দরী মহিলা জিজ্ঞেস করলেন - “আচ্ছা, এই কামরায় উঠতে পারবো? যা ভিড় দেখছি …”। বললাম, “জানি না। আমিও আজ প্রথম।” একটু এগিয়ে এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম - “কোন ট্রেন আসছে?” তিনি উত্তর দিলেন - “লক্ষ্মী।” এ নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমার বর যখন ট্রেনে যাতায়াত করে, তখন ফিরে এসে কোনোদিন বলে - আজ লক্ষ্মীতে এলাম, কোনোদিন বা ডায়মণ্ড। প্রথম প্রথম নামগুলো নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, এখন সয়ে গেছে।

লক্ষ্মী এলো। সবাই ওঠার পর আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো আস্তে আস্তে উঠলাম। কষ্ট হলো না। উঠেই জিজ্ঞেস করলাম, “বারুইপুর কোনদিকে পড়বে?” তাহলে সেদিকেই দাঁড়াবো। এক মহিলা বললেন “দেরি আছে, ভিতর দিকে চলে যান।” গেট থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকের সিট অব্দি গেলাম। সিটের একদম শুরুতে বসা এক মহিলা আর তাকে ধরে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন আর এক মহিলা। দুজনে পরিচিত। দুজনের খুব গল্প। আমি দাঁড়াতেই সিটে বসা মহিলা বললেন, “পিছনে নিজের ঠেল রাখো।” বললাম — “কী?” তিনি আবার একই কথা বলে বুঝিয়ে দিলেন - “চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়াও খুব ঠেলাঠেলি হবে, যেন পড়ে যেও না।” আমি বললাম, “এইরে আমার পিঠে তো একটা সিস্ট হয়েছে, পুরো টনটনে ফোঁড়া। সেটা তো তাহলে আজ ফেটে যাবে!” তিনি শুনে বললেন, “এমনই হয়, তাই বললাম শক্ত হয়ে দাঁড়াও।” আমার হাতে বইয়ের প্যাকেট ছিলো, তাঁকেই বললাম — “ধরবেন?” বললেন, “হ্যাঁ, রাখো আমার কোলে।” আমি বইয়ের প্যাকেট, কাঁধের ব্যাগ সব তাঁর কোলে নামিয়ে দিলাম। 

একটু ঠিক করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। দেখি সিটের পাশে পাশে করিডোরগুলোতে  নানান বয়েসের কালো কালো মাথা। নিচে সবাই থরে থরে বসে। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ ঝিমোচ্ছে, কারো হাত অন্যের মাথায় বিলি কাটছে, কেউ কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে, কেউ উকুন বাচছে, কেউবা রুটি খাচ্ছে। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবাই এমন নিচে  বসে কেন?” সেই মহিলা বললেন, “কি করবে, সব ভোরেরবেলা কাজে বেরিয়ে ছিলো, সবার বাড়ি কাজ করে এখন ফিরছে। ওরা আর দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে না। তাই এমন করেই সব নিচে বসে পড়ে। আবার তো কাল ভোরে বেরোতে হবে।” বললাম, “হুম।”
তারপর ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম — “আপনি কোথায় নামবেন?” তিনি ‘বারুইপুর’ বলেই তাঁর সামনের মহিলাকে দেখিয়ে বললেন “আমি নামলে, ও বসবে। তুমি ববসতে পাবে না।” বললাম, “না না বসার জন্যে জানতে চাইনি। বরং ভালোই হয়েছে আমি আপনার সঙ্গে নেমে যাবো। আমি এদিকের কিছু চিনি না।”
তিনি এবার হেসে জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, বাড়ি কোথায়, আবার ফিরবো কিনা? বললাম, “হ্যাঁ ফিরবো বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। এই বইগুলো দিয়েই ফিরে পড়বো।” বই শুনে তিনি তাঁর মেয়ের গল্প শুরু করলেন। তাঁর মেয়েও বই পড়তে খুব ভালোবাসে। “এই সেদিন কলেজস্ট্রিট গিয়ে তিন হাজার সাতশো টাকার বই কিনে এনেছি। তিন হাজার সাতশো। বুঝলি?” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে -  “মেয়ে, আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। ফাস্ট ইয়ার। অনার্স।” জানতে চাইলাম কোন কলেজ। উত্তর দিলেন বারাসত কলেজ। 

এরমধ্যে এক ফুলওলা উঠলো রজনীগন্ধা ফুলের মালা নিয়ে। বসে থাকা মহিলা তার গায়ে হাত দিয়ে বললেন - “ও মনা, দুটো ফুল দে আর পঁচাত্তর টাকা খুচরো দে।” মহিলা আরো কয়েকদিনের হিসেব দেখিয়ে ওই টাকা বলেছেন। দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা অবাক হয়ে বললেন — “একি! অমন করে কথা বলছো কেন?” তিনি বললেন “কেন? বলেছি তো কি হয়েছে? ও তো বাচ্চা ছেলে। তুই থাম দিকিনি।” বলেই আরম্ভ হলো কার বাড়িতে কত বড় ঠাকুর আছে তাই নিয়ে আলোচনা। বসে থাকা মহিলা দু হাত দিয়ে ইদেখিয়ে বললেন - “আমার বাড়িতে একটা এত্তো বড়ো তারামা আছে।” যিনি দাঁড়িয়ে - “আমার বাড়িতে একটা এত্তো বড়ো কালী।” উনিও আবার ভ্রু নাচিয়ে - “আমার বাড়িতে একটা শিবও আছে।” ওই মহিলা বললেন, “তুমি যে ফুলটা কিনলে আমি নিয়ে চলে যাবো।” উনি — “তা যাবি তা যাবি, আমি কি করবো? নিয়ে গিয়ে কারো না কারো পায়ে তো দিবি? নিজে তো আর গলায় পরবি না? তাহলেই হবে।” বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - “কি বলো তাই না?”

কোলে রাখা বইগুলো একটু গড়িয়ে যাচ্ছিলো। তিনি সেগুলো একটু টেনে তুলে নিয়ে শুরু করলেন, “আমার মেয়ের খুব বই পড়ার শখ। যেখানেই যাক, বই দেখতে পেলেই হলো। হাত খোঁচায় আর বলে - ওমা ওমা দাও না, কিনে দাও না। আমি বিরক্ত হয়ে বলি - কি? বই কিনে দাও না মা। হাত দিয়ে কিভাবে খোঁচায় সেটা অন্য মহিলার গায়ে করে দেখাতে দেখাতে - আমি বলি তোর কি একটা নেশা নাকি বলতো? যেখানেই যাবি শুধু বই।” আবার আমার দিকে তাকিয়ে — “আমার মেয়ে। খুব বইয়ের নেশা। একদম সরস্বতী।”

অন্য মহিলা — “কি বই কেনে?”
— “তা আমি জানি না। ওই ইংরেজি ফিংরেজি কিছু একটা হবে, গল্পের বইও কেনে অনেক। একবার তো মেলায় গিয়ে রান্নার বইও কিনলো। আমি খুব বকেছি-  এটা কি তোর একটা নেশা নাকি?”
অন্য মহিলা — “তা ভালো তো। বইয়ের নেশা।” 
তারপর তিনি খুব হেসে — “আর আমার ছেলে কি করেছে আলমারি থেকে তার বই নামিয়ে এতোওও গুলি ভরে রেখেছে! মেয়ে তো দেখতে পেয়েই চিৎকার করে - ওমাআআ... দেখে যাও ভাই কি কি করেছে, বলেই সে কি নাকে কান্না, আঁউমাঁউ করে নাচছে। ওর বাবা বলেছে এবার এক কাজ কর - তোর ছেলে তো ছাগল, ওর দ্বারা কিছু হবে না। ওকে গুলি রাখার জন্যে একটা আলমারি কিনে দে।”

এই শুনতে শুনতেই অনুভব করলাম আমার পায়ে কে যেন একটা পাথর চাপিয়ে দিলো। ঘুরে দেখি এক বয়স্ক মহিলা। বললাম — “আমার পায়ে কি চাপালেন একটু তুলুন।” তিনি সরিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক আছে কিনা। বললাম ‘হ্যাঁ।’ বসে থাকা মহিলা বয়স্ক মহিলাকে খুব উপদেশ দিয়ে আরো ভিতরে চলে যেতে বললেন। তিনি নামবেন জয়নগরে। 

ওই মহিলা আবার এক গল্প শুরু করলেন — “এতো ভিড়ে একবার আমি নামতে পারছিলাম না। কি করেছি, ওই ধরার হাতলগুলো ধরে ঝুলে ঝুলে একটা থেকে আর একটা ধরেছি। মেঝেতে পা রাখিনি। পুরো পাঁচটা ধরেছি আর লাফ কেটে বেরিয়ে গেছি।”

— “ট্রেনের লোকেরা তোমাকে কিছু বলেনি?”
— “বলেনি!? বলছে বলছে! আমার তো তখন নামতে হবে। সবাই আমাকে গাল দিতে শুরু করেছিলো…” বলে গালাগালগুলো তিনি বললেন. শরৎচন্দ্রের সাবলীল ভাষায় মেয়েরা যা তাই, তবে তার আগে তিন অক্ষর জুড়ে যা দাঁড়ায় তা তিনি অবলীলায় বলে গেলেন। “তারা গালাগাল দিচ্ছে আমার তো তখন হাসি পাচ্চে। আমি ভাবছি তোদের মুখ আছে তোরা দে, তোদের গালের ভয়ে কি আমি নামবো না? ধ্যার! একদম লাফ কেটে বেরিয়ে গেছি। আমার ছোটমাসি এখনো সে গল্প বলে। উফ! সেবার তুই যা করেছিলি! বলেই হাসি।” 

আমিও সেই ঘটনাটা কল্পনা করার কিছুটা চেষ্টা করলাম। সুবিধে করে উঠতে পারলাম না। 

ততক্ষণে মল্লিকপুর এসে গেছে। আমি তাঁর কোল থেকে বইয়ের প্যাকেটটা নিয়ে গেটের সামনে এসে অনেকের পিছনে এ টি এমের লাইনের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বারুইপুরের কাছকাছি উঠে এসে আবার এক মহিলাকে খুব ধমক দিলেন। কেনো গেটের সামনে? নামবে তো অনেক দূরে। ধমক খেয়ে সে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সবাই কেমন নড়ে গেলো। নড়ে যেতেই অন্য এক মহিলার নখ ওনার কপালে ভ্রুর ঠিক ওপরে লাগলো। লেগে একটু আঁচড়ে ফুলেও গেলো। তখন মহিলা নিজের কপালে হাত দিয়ে বললেন — “কেটে গেলো নাকি গো? উফ তোমার নখটা যা লাগলো।” যাঁর নখে লেগেছে তিনি ওনার কাটা জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে — “না না দিদি কাটেনি, কাটেনি। ওই যে তুমি ভুরু প্লাক করেছো না? ওটায় তোমার গোটা বেরিয়ে গেছে। সবার স্যুট করে না তো ওটা। তোমার তা থেকেই গোটা বেরিয়েছে।” আর যাঁর কেটে গেলো তিনি বলতে থাকলেন — “এতোক্ষণ ছিলো না, মনে হয় তোমার নখ….”। যাঁর নখে এটা হলো, তিনি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে শুরু করলেন — “আচ্ছা দিদি ও এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তোমার কি এসে যাচ্ছিলো? ও ভিড়ে চাপাচাপি হয়ে মরতো মরতো, তোমার কি? এদিকে তো আমরা হুড়োহুড়ি করে পড়ে যাচ্ছিলাম….”

স্টেশন এসে গেলো। নামলাম। এদিকের ট্রেনে সবাই নামার অপেক্ষায় কেউ থাকে না। যাদের ওঠার দরকার তারা ঠেলে উঠতেই থাকে দেখলাম। সঙ্গে নানান বাণী - “কারো যেনো নামার ইচ্ছে নেই, দেখো কেমন নামার চাল দেখো, ট্রেন যেনো ওদের জন্যে দাঁড়িয়েই থাকবে। যেন সব বাপের ট্রেন পেয়েছে …।”

লক্ষ্মী থেকে নেমে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করার চেষ্টা করছি। তখন ওই মহিলা আবার এসে দেখালেন — “এই দেখো আমার মেয়ে।”  আমি মুখ তুলে তাকিয়ে প্রথমে অবাক হয়ে তারপর একটা হাসি দিলাম। আর মেয়েটি আরো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো। 

Comments

Popular posts from this blog

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত

অন্ধকারের উৎস হতে