ঘেঁটু

মনে পড়ে, রোজ সকালে গাড়ি বারান্দায় পড়তে বসতাম। শীতকাল হলে পূর্বদিক, গরমকালে পশ্চিম। পড়তে বসে পড়ার থেকে মন দিয়ে এদিক সেদিক দেখাটাই ছিলো বেশি দরকারী কাজ। এমনই একটা দরকারী কাজ ছিলো ছোটঠাকুমার ঘেঁটু পুজো দেখা।
প্রতি বছর ফাল্গুনের সংক্রান্তির সকালবেলা এই পুজো হতো। পুজোর জন্যে লাগতো মুড়ি ভাজার পুরোনো ঝুলওলা একটা  মাটির খোলা, তেল হলুদে চোবানো ছোট ন্যাকড়া, তিনটে কড়ি, ছোট ছোট তিনটে গোবর দিয়ে পাকানো বল, ঘেঁটু ফুল, সিঁদুর, ধান, দূর্বা। মাটির খোলাটা নিকোনো জায়গায় বসিয়ে দিতো। তার উপর তিনটে গোবরের বল লাগিয়ে, সেই বলগুলো কড়ি, সিঁদুর ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজাতো। খোলার উপরে ন্যাকড়াটা বিছিয়ে দিতো। এই পুজোর জন্যে আলাদা করে পুরোহিত লাগতো না, বিধবা মহিলারাই করতে পারতো। বাড়ির সামনে বা একটু দূরে তিনমাথা, চারমাথার মোড়ে পুজোটা করতে দেখেছি। কারণ পুজোর পরে ছেলেরা মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে খোলাটা ভেঙে দিয়ে দৌড়ে পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আসতো। সেটা ছোটঠাকুমাই বলে দিতো - "দৌড় দৌড় শিগগিরি পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আয়, না হলে খোস পাঁজরা হবে।" ছেলেগুলো খোলাটা ভেঙে দিয়ে দৌড়তো।

কেউ কেউ এসে বলতো - "ছোটঠাকুমা এই দেখো হাত পা ধুইনি।" ঠাকুমা সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠতো - "মুখপোড়া যা, শিগগির ধুয়ে আয়, খোস পাঁজরা হলে ভালো হবে?" ঘেঁটু ফুলগুলো সাদা আর বেগুনী রঙ মিশিয়ে বেশ সুন্দর দেখতে। পুজোর মন্ত্র কী ছিলো জানি না। ওই ছোটঠাকুমা বিড়বিড় করে যা বলতো তাই। জিজ্ঞেস করেছিলাম কয়েকবার, বলেনি। বলতো, "ওই ছেলেপুলেরা, নাতি নাতনীরা যাতে ভালো থাকে সেটাই বলি।" পুজোর পরে ওই ন্যাকড়াটা এনে চোখে বুলিয়ে দিতো, খোলার ঝুলটা কাজলের মতো পরিয়ে দিয়ে বলতো চোখ ভালো থাকবে। এখানেই ছোটঠাকুমার কাজ শেষ। 

সন্ধ্যেবেলা পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা আসতো ঘেঁটু ঠাকুর নিয়ে। তারা ঘেঁটুর গান গেয়ে চাল পয়সা চাইতো। তারপর সেই চাল দিয়ে তারা ফিস্ট করতো। রঙীন কাগজ, খবরের কাগজ, কঞ্চি দিয়ে বানাতো ছোট্ট একটা ডুলি। তার ভিতরে ছোট ছোট টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো আলোর মালা। আর ঘেঁটু ফুলের ভিতর থেকে উঁকি দিতো ছোট্ট ঘেঁটু ঠাকুর। পুরোটাই সাদা তুলো দিয়ে তৈরি। তার ঘাড় নড়তো। ছোটঠাকুমা মারা যাওয়ার কয়েকবছর আগে থেকে তারও ঘাড় নড়া রোগ হয়েছিলো। সবাই তাকে বলতো ওই ঘেঁটু পুজো করে করে তোমারও ঘেঁটুর মতো ঘাড় নড়ে। ঘেঁটুর ডুলিটা ছেলেগুলো কাঁধে করে নিয়ে আসতো। তাদের গানের কথাগুলোর একটু রকমভেদ ছিলো। গায়েন পাড়ার ছেলেরা যে কথাগুলো বলে গান করতো, মোড়ল পাড়ার ছেলেগুলো পুরোপুরি সেটাই বলতো না। একটু তফাৎ থাকতো। এখন হয়তো সেটা আর একটু বদলে থাকবে।     
আমাদের গ্রামে বা পাশের গ্রামে কোথায় কোথায় ঘেঁটু পুজো হতো তা বোঝা যেতো ওই ভাঙা খোলার টুকরোগুলো দেখে। কেউ কেউ সেগুলো ভেঙে প্রায় গুঁড়ো ধুলো করে দিতো। ঘেঁটুর গানটা ছিলো অনেকটা এইরকম:

ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি,
ঘেঁটুকে দাও গো পয়সা কড়ি।
ও ঘেঁটু তোর ক বেটা?
সাত বেটা সতীনে।
ফুল তুলতে গেলিনে? 
ফুলের নামে একি পাই --
হাবড়ি ঝুবড়ি আদা পাই। 
আদা দিয়ে মাল্লাম টান,
শিগগিরি দাও গো ঘেঁটুর দান। 
যে দেবে মুঠো মুঠো, তার হবে হাত ঠুঁটো,
যে দেবে থালা থালা, তার হবে সোনার বালা।
যে দেবে বাটি বাটি, তার হবে সাত বেটি,
যে দেবে কাপ কাপ, তার হবে সাত বাপ।
যে দেবে ঘড়া ঘড়া, তার ঘরে ………
যে দেবে মড়াই মড়াই, তার ঘরে সোনা ছড়াই। 

এই গান বা ছড়াটা অনেকে অনেকরকমভাবে বলতো। আমি এর দু-তিনটে সংস্করণ অল্প অল্প মনে রাখতে পেরেছি। এখন আমাদের গ্রামের ছেলেরা ঘেঁটুর গান গেয়ে এই আনন্দ করে কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের পাড়ার পুজোটা আর হয় না। আমি এবারে ভাইফোঁটায় গিয়েছিলাম ছোটঠাকুমার বৌমা বললো - "দেখ আমাদের আর ঘেঁটু পুজো কেউ করে না। তোর বড়মা, মেজমা সবাইকেই কতবার বলা হলো কেউ করলো না, পুজোটা উঠে গেলো।" তবে হুগলি জেলার সব গ্রামে হতো বা হয় কিনা তাও জানি না। আমাদের গ্রাম এবং পাশের আরো দু-তিনটে গ্রামে হতে দেখেছি, গল্পও শুনেছি। 

এই ঘেঁটু ঠাকুরের উৎস আমি জানি না। বাংলার লোকসংস্কৃতির কোনো বইতে নিশ্চয়ই আলোচনা আছে, কিন্তু আমি পড়িনি। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে দু একটা ছোট লেখা পেয়েছি। তাতেও ঘেঁটুর উৎস সম্পর্কে কিছু বলা নেই। শুধু এটুকু জেনেছি যে ঘেঁটুর ভালো নাম ঘন্টাকর্ণ (বা ঘন্টাকক্ষ), তিনি শিবের অনুচর। জীবনানন্দের কবিতার ভাঁটফুলই ঘেঁটুফুল। লোক দেবতাদের মধ্যে ঘেঁটু হলো খোস পাঁজরার দেবতা। তাই হয়তো ছোটঠাকুমা বলতো হাত পা না ধুলে খোস পাঁজরা হবে।

তবে আমার মনে হয় ঘেঁটুর সঙ্গে সান্টা ক্লজের একটা খুব মিল আছে। ঘেঁটু ঠাকুর পুরো সাণ্টার মতো দেখতে নয়। দুজোনেরই দুধ সাদা দাড়ি, দুজনেই খুব বুড়ো। একজন আসে শীতের শুরুতে, আর একজন ঠিক শীতের শেষে। দুটো উৎসব ঘিরেই আছে বাচ্চার আনন্দ।  সান্টা ক্লজের গল্পে দেখেছি তিনি কালে কালে বহু শিশুকে সাহায্য করে চলেছেন। এখানে ভালো শিশু, দুষ্টু শিশুর একটা গল্প আছে। ভালো শিশুর একরকম উপহার, দুষ্টু শিশুর আর একরকম। দুষ্টুদের ভালো হয়ে ওঠার একটা অপেক্ষা থাকে, ভালো হলে তবে পরের বছর ভালোদের মতোই উপহার পাবে, না হলে পাথর আর কয়লাই বরাদ্দ। বিভিন্ন দেশে সান্টার উৎস নিয়েও বিভিন্ন মতভেদ আছে, বিভিন্ন বিশ্বাস আছে। পালন করার রীতিতেও আছে আলাদা আলাদা ধরণ। 

সান্টা ক্লজের উৎসব এখন শুধু সাহেবী সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমী সমাজের নকল করে আমাদের দেশেও অনেকে বড়দিনের আগের রাতে বারান্দায় মোজা রেখে দেয়। একটাই আশা সান্টা কিছু দিয়ে যাবে। কলকাতাতেও এটা বেশ রমরমিয়ে চলে। গ্রামের ছেলেরা সান্টা নিয়ে এখনো অতোটা মাতামাতি করে না।  ভাবতে গিয়ে মনে হলো, তখন ওই ঘেঁটুই আমাদের গ্রামের ছেলেদের কাছে সান্টার মতো ছিলো। ঘেঁটু আগের রাতে কিছু দিয়ে না গেলেও ঘেঁটুপুজোকে কেন্দ্র করেই তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাল, ডাল, একটু টাকা-পয়সা জোগাড় করে নিজেদের মধ্যে একটা দিন আনন্দ করতো। এখনকার ছেলেগুলো আস্তে আস্তে সান্টার স্বাদ পাবে, দিনে দিনে ওই সাজ-পোশাক গ্রামেও বিক্রি হবে। তারাও পরে ফেসবুকে ছবি দেবে। কিন্তু ঘেঁটুর কথা জানবে কিনা সন্দেহ আছে। 



কালে কালে লোককথা, লোকছড়া, লোকগল্প লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলো সংরক্ষণ বা চর্চার অভাবে আবার হারিয়েও যায়। এই ঘেঁটু হয়তো আস্তে আস্তে হারিয়েই যাবে, যেমনভাবে ছোট ঠাকুমার সঙ্গে হারিয়ে গেছে আমাদের পাড়ার ঘেঁটু। 

Comments

Popular posts from this blog

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত

অন্ধকারের উৎস হতে