অন্ধকারের উৎস হতে

আজ আমার কলেজে প্রথম দিন। নতুন জায়গা। স্যার ম্যামরা সবাই নতুন। ক্লাসেও সবাই নতুন। মনের মধ্যে এক নতুন স্বপ্ন, উত্তেজনা। একটু একটু নার্ভাস লাগছে। তবুও মন বলছে এগিয়ে যাও, তুমি পারবে। 

এক সপ্তাহ আগেও ভাবিনি আমার জীবনে সত্যিই এই দিনটা আসবে। আমার জীবনটা ঠিক যেন একটা গল্পের মতো। 

——

আমার নাম লক্ষ্মীমণি সাঁতরা। বয়েস আঠেরো। কদিন আগেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি। ফার্স্ট ডিভিশন। রেজাল্ট নিয়ে সেদিন নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছিলাম। খুশিতে টগবগ করতে করতে এসে মাকে বললাম - “মা আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছি।” মাও খুশি হয়েছিলো, হয়তো প্রকাশ করতে পারেনি। ছোট বোন দৌড়ে এসে বলেছিলো - “দিদি তুই ফাস ডিবিশন পেয়েছিস? কি মজা! কি মজা!” সে এটার মানে কিছু বুঝেছিলো বলে মনে হয় না, তবুও আমার থেকে কম নাচেনি। মেজো বোন মুচকি হেসেছিলো। তখন বুঝিনি কেন। 

পাড়ার যারা কেউ কিছুই বোঝে না, তারাও আমাকে নিয়ে অনেক আনন্দ করেছিলো। লকু আমাদের কত ভালো মেয়ে। এই তো কি ভালো রেজাল করলো। আমাদের সাঁতরা পরিবারে তুই তো পোথম এমন রেজাল করলি মা। এর আগে আমাদের কেউ এতোদূর পড়েইনি। আমিও তাদের বলেছিলাম - “দেখবে আমি আরো ভালো করবো, আমি কলেজে পড়বো, বড় হবো, চাকরি করবো।”

সবাই বলেছিলো - করবি তো মা, করলে তুইই করবি, পারলে তুইই পারবি।  

আমরা খুব গরীব। বাবা দিন মজুর। দুটো ছাগল আর একটা গরু আছে। তা থেকেও কিছু টাকা আসে। আমাদের কোনোমতে চলে যায়। তার ওপর তিন বোনের পড়াশুনো। বাবা মাঝে মাঝেই অভাবের কথা শুনিয়ে আমাদের কাছে চেঁচামেচিও করে। নয় নয় করে পাঁচ জন। খেতে পরতে যা খরচ, দিনরাত গায়ে-গতরে একা খেটে মানুষটা না চেঁচিয়ে সামলাতে পারে না।

আমাদের গরুটা রোজ দুবেলা দুপোয়া করে দুধ দেয়। এক পোয়া করে মা বেচে দেয়। সকালবেলার একপোয়া দুধ নিয়ে যায় আমাদের পাড়ার তপতী কাকীমা। আর সন্ধ্যেবেলারটা ও পাড়ার নিতাই কাকা।

রেজাল্ট বেরোনোর দিন সন্ধ্যেবেলা মা যখন গাই দুইতে যাচ্ছিলো - আমি বললাম, “মা আজ আমি বাছুর ধরতে যাবো।” বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা চালাঘরে আমাদের গরুটা বাঁধা থাকে। ওটাই ওর গোয়াল। মা বললো — “চল”।

নিঃঝুম, নিস্তব্ধ সন্ধ্যে। চারদিক খুব ফাঁকা। শান্ত। আবহাওয়াটাও ছিলো খুব থমথমে।

আমি বলেছিলাম — “মা আমি কলেজে পড়বো।” মা সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে যেন গর্জে উঠে বলেছিলো - “উঁউউ! ঘুঁটে কুড়ুনির মেয়ে আবার রাজরাণী হবার স্বপ্ন দেখে! কলেজে পড়বে! কত শখ। ওসব আমাদের মতো ঘরে মানায় না। বড় হয়েছো, এবার বিয়ে দিতে হবে। পাড়াগাঁয়ে এতো বড় মেয়ে ঘরে রাখার যে কি জ্বালা তা তোরা কি করে বুঝবি? নয় নয় করে তিনটেই মেয়ে হতে হলো? আমার এমন পোড়া কপাল। আমি এমন হত ভাগ্য।” বলতে বলতে মায়ের সুর কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো — “ছেলে না থাকার জ্বালাও অনেক মা, লোকে আমাকে গালি দেয়, আমার হাতের জল নাকি শুদ্দ নয়।” তারপর শোনালো — “বিয়ে করে পরের ঘরে হেঁসেল ঠেলতেই তো হবে, আবার এতো পড়ে কি হবে? তোর বাবা কদিন ধরেই বিয়ের কথা বলছে। আর তাছাড়া কলেজে পড়ার খরচ এতো জোগাবো কি করে আমরা?” 

আমি বলতে চেয়েছিলাম কন্যাশ্রীতে যে টাকাটা পাবো সেটা দিয়ে সরকারি কলেজে আমার নিশ্চিন্তে তিনবছর পড়া হয়ে যাবে। সব আমার হিসেব করা ছিলো। কলেজে পড়তে বছরে প্রায় পাঁচ থেকে ছ হাজার মতো লাগে। তারপর বই-টই নাকি কিনতেই হয় না, লাইব্রেরী আছে। আর আমি পাবো পঁচিশ হাজার টাকা। তা দিয়ে আমার দিব্যি তিন বছর তো বটেই, এমনকি পাঁচ বছরও পড়া হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। মা আর কোনো কথায় কান না দিয়ে আমার বিয়ে নিয়েই বলে চলেছিলো।

মায়ের মনটাও বুঝেছিলাম। মেয়ে পড়াশুনো করে নিজে রোজগার করবে — এত বড় স্বপ্ন দেখার ভরসা মা করতে পারে না। তার চেয়ে মা ভাবতে পারে — আমার লকুরও একটা ঘর হবে, বর হবে, লকু সংসার করবে। সেটা দেখেই মায়ের শান্তি। 

আমার মেজো বোনের জন্মের কথা আমার মনে নেই, কিন্তু ছোট বোন যখন হয় সেটা আবছা মনে আছে। বাড়িশুদ্ধ সবাই আশা করে ছিলো ছেলে হবে। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখবে লক্ষ্মণ। বংশে বাতি দেবে। এসব নিয়েই আলোচনা চলছিলো। কিন্তু সবার আশায় জল ঢেলে, সবার মুখ কালো করে মা তৃতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলো।

এতো হতাশার মধ্যেও মা ছোট মেয়ের নাম রেখেছিলো কমলা। 

আমি আমার দুচোখে রঙীন স্বপ্ন নিয়ে জাল বুনেছিলাম। কলেজে পড়বো। কলেজ মানে শুনেছি অনেক বড় ব্যাপার। কলেজে পড়া তৈরি করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়া বলতে হয়না। যখন খুশি যাওয়া, যখন খুশি আসা। কলেজ পালিয়ে আবার এখান ওখান যাওয়াও যায়। কলেজে ক্যান্টিন আছে। এতো ফাঁকি, এতো আনন্দ তার মধ্যেই কলেজে পড়ে বড় হওয়া যায়। চাকরি পাওয়া যায়। সবই কেমন আমাকে অবাক করে দেয়। আমি বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন কলেজে ফর্মের খোঁজ শুরু করে দিয়েছিলাম।

—— 

হঠাৎ একদিন আমার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। শুনতে পেলাম বাবা মাকে বলছে — “লকুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি।” মা হঠাৎ শোনা খবরে এতোটুকু আশ্চর্য না হয়ে খুশিতে আত্মহারা — “কি বলছো গো? বিয়ে ঠিক করে ফেলেছো? তা কেমন ছেলে গো? ঘর, বর সব ঠিক করে খোঁজ নিয়েছো তো? ঠাকুর তাহলে আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছে বলো? দুগগা দুগগা।”
 
“ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছে বলছো কেনো? বলো আমাদের মা-মাটি মুখ তুলে চেয়েচে। আমার লকু মা তার বিয়ের টাকা তো নিজেই জোগাড় করেচে। কন্যাশ্রীর যে টাকাটা পেয়েছে তা দিয়েই তো তার বিয়ের ঠিক করেছি। ও তো আমার লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। আমি কী তার জন্যে এতোটুকু কিছু দিতে পারছি, সে’ই তার বিয়ের টাকা জোগাড় করেছে …”

মা আমাকে খুব ভালো করে বুঝিয়েছিলো আমাদের মতো বাড়ির মেয়েদের কেন বিয়ে করে নিতে হয়। সেদিন আর এতোটুকু রাগারাগী করেনি। মা বলেছিলো — “জানিস লকু তুই যে টাকাটা পেয়েছিস তা দিয়েই তোর বিয়ে হয়ে যাবে। তোর বাবাও বলছিলো — তুই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। আমাদের মতো বাড়িতে এতো পড়ার স্বপ্ন দেখলে হয় না মা। আমাদের এতো টাকা কোথায় যে তোকে আরো পড়িয়ে, অনেক খরচ করে বিয়ে দেব? তাছাড়া তোর দিদা বলতো — মেয়েরা বেশি ল্যাখাপড়া শিকলে তাদের বর জুটতেও কষ্ট হয়। আরো বেশি টাকা লাগে বিয়ে দিতে।”

আমার সব রঙীন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে, মা সেদিন আমাকে এক ধাপে অনেক বড় করে দিলো। 

দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। কিন্তু মেনে নিতে হয়েছিলো। একটু একটু করে মনকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম —  অন্য একটা ঘর, একটা অচেনা লোক আমার বর, অন্য একটা বাড়ি আমার সংসার। আরো ভাবতে থাকলাম বিয়ের সাজ, ছাতনাতলা, বাসরঘর। কনে সাজে লাল শাড়ি, লাল টিপ পরে শ্বশুর বাড়ি।

মা বলেছিলো — “জানিস ওপাড়ার শিউলি যে টাকাটা পেয়েছে, সেটা দিয়ে তার মাও তার জন্যে বিয়ের গয়না করে রেখেছে।”

বলেই আবার শুরু করলো — “করবেই তো। এটা কী চাট্টিখানি টাকা মা? আমাদের মতো ঘরে একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এছাড়া আমাদের আর কী উপায় আছে।” 

বাবা আমার সঙ্গে বসে গল্প করে না, জরুরী কথা আলোচনা করে না। প্রায় সব কথাই মায়ের মুখে শুনি। বিয়ের কথাটাও আমি আগে মায়ের কাছেই শুনেছি।

এরপর একদিন সকালে বাবাও আমার মাথায় হাত রেখে, আদর করে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলেছিলো। “মা লকু, তোর বিয়েটা আমি ঠিক করে ফেলেছি। ছেলেটা ভালো। আর না করিনি। এই তো তোর নিতাই কাকার শালার ছেলে। ওরা খুব সুখ্যাতি করেছে। ছেলের একটা ছোট ব্যবসা আছে। নাম উত্তম পাত্র। পাত্র পদবী। ভাবছি পরের মাসেই বিয়েটা দিয়ে দেবো। 

নিতাই কাকা আমাদের বাড়ি রোজ আসে। সন্ধ্যেবেলা বাবার সঙ্গে বসে বিড়ি খেয়ে, গল্প করে তবে বাড়ি যায়। বাবা আর নিতাই কাকা দুজনে এখন একশো দিনের মাটি কাটার কাজে নাম লিখিয়েছে। রোজ সকালে একসঙ্গে মাটি কাটতে যায়। বাবা তাকে ভরসা করে। নিতাই কাকা বলছে যখন পাত্র নিশ্চয়ই ভালোই হবে। 

——

দেখতে দেখতে এসে গেলো বিয়ের দিন। 

অনেক তোড়জোড় হয়েছিলো। আমার কন্যাশ্রীর টাকাটা তো পাত্রপক্ষের পণ। বাবা বড় মেয়ের বিয়ে দেবার আনন্দে আরো কিছু ধার করেছিলো। প্রায় একশ লোক। চেঁচামেচি হৈ হুল্লোড়, একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড। গ্রামে খুব গরীব পরিবারেও সবাই মিলেমিশে আনন্দ করে, সবাই সবাইয়ের কাজে সাহায্য করে। ছোট খাটো অনুষ্ঠানও বড় আকার নেয়। 

রাতে বর এলো, বরযাত্রী এলো। বিয়ের পিঁড়িতে উঠে শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সিঁদুর দান করে, নিয়ম মেনে বিয়েও হয়ে গেলো।

এমন সময় আচমকা কয়েকজন পুলিশ নিয়ে অচেনা কয়েকজন লোক এসে হাজির হলো। বিয়ে বাড়িতে পুলিশ, সবার মাথায়  আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। ওরা বললো, যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়া হলো তার নাকি বছর পাঁচেক হলো বিয়ে হয়ে গেছে। দুটো ছেলে মেয়ে আছে। আয় বলতে আসলে কিছু নেই। পণের টাকার লোভে বউকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে আবার বিয়ে করতে এসেছে। 

উত্তম পাত্র নানাভাবে বলতে চাইলো ওগুলো সব মিথ্যে কথা। কিন্তু পুলিশের রুলের গুঁতোয় বেশিক্ষণ পেরে উঠলো না।

এই চরম সঙ্কটে বাবা নিতাই কাকার খোঁজ করতে থাকলো। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। আমাদের অতিথিদের মধ্যেও না, বরযাত্রীর দলেও না। 

শেষে বর সব স্বীকার করলো। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেলো। বিয়ের হাট ভেঙে গেলো। 

অনেক কথা হলো। কেউ বরকে গালাগালি দিলো, কেউ আমার বিয়ে ভেঙে যাবার কলঙ্কে সহানুভুতি দেবার ভান করে অনেক কথা শুনিয়ে গেলো। কেউ কেউ বললো “লক্ষ্মী না ছাই, লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের মতই”। কেউ বললো “একবার তো বিয়ে হয়ে গেছে, আর এ মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে?” 

—— 

তারপর রাত বাড়লো। সবাই চলেও গেলো। রয়ে গেলাম আমরা পাঁচজন। 

মা কাঁদছিলো, আমাদের আর মুখ দেখানোর কিছু রইলো না। বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো। দুই বোন ভয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি তখনো বিয়ের সাজে। সিঁথিতে সিঁদুর। কপালে চন্দন। চিন্তা ভাবনা করারও কোন ক্ষমতা ছিলো না আমার। 



এমন সময় আমার দিনমজুর অশিক্ষিত বাবা হঠাৎ বলে উঠেছিলো — “আমি বুঝতে পারিনি রে। টাকাটা তোর পড়াশুনোর জন্যেই, বিয়ে দেবার জন্যে নয়। ভুল হয়ে গেছে রে মা। চল তোকে কাল কলেজে ভর্তি করে আসি।” 

Comments

Popular posts from this blog

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত