বাংলায় বাংলা

সন্তোষপুর মোড় থেকে আমার কলেজ প্রায় এক কিলোমিটার। সেটুকু রাস্তা অটো বা রিক্সায় যেতে হয়।

একদিন হঠাৎ অটোতে উঠে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। “Where will you get down madam?”
আমি বাংলায় বললাম, “কলেজে নামবো।”
“OK, I thought so.”
আমি হেসেছিলাম। নামার সময় যখন ভাড়া দিতে গিয়েছিলাম, তখন অটোওয়ালা জিজ্ঞেস করেছিলো, “Don’t you have change?”
আমি বলেছিলাম, “না।”
অটোওয়ালা বলেছিলো, “It’s OK, nobody seems to have change. I’ll give you change. ”

অবাক হবার কিছু নেই। আমার অন্য কলিগরাও ওর অটোতে উঠেছে। আমাদের দেখলেই সে ইংরাজী বলে।

আরো একদিনের ঘটনা। একদিন কলেজ যাওয়ার সময় সন্তোষপুর মোড়ে গিয়েই শুনলাম অটোস্ট্রাইক, একটা অটোও যাবে না। কোনো রিক্সাও যেতে চাইলো না, বা সুযোগ বুঝে ভাড়া তিনগুণ চাইতে লাগলো। কয়েক মিনিট পরে শুনতে পেলাম, “ম্যাডাম যাবেন? দশ টাকা দিতে হবে কিন্তু।” পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এক রিক্সাওলা আমাকে কথাটা বলছে। অলরেডি তার রিক্সায় এক মহিলা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। শেয়ারে যেতে হবে তিনি দশ আমি দশ। পনেরো টাকা ভাড়া হয় দুজনে, রিক্সাওলার কুড়ি হলো, সেও খুশি আমিও খুশি। তবে সেই মহিলা খুশি ছিলেন কিনা জানিনা, তাঁর মুখটা ব্যাজারই ছিলো। আমি রিক্সায় চড়ে বসলাম।

কিছুটা যাওয়ার পরেই ওই মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি স্কুলে পড়ান?”
বললাম, “না, কলেজে।”
“ইংলিশ মিডিয়াম?”
বললাম, “না, বাংলা।”
উনি আবার বললেন, “এখানে ইংলিশ নেই?”
হ্যাঁ আছে, ইংরেজি নিয়ে পড়লে তো ইংরেজিতেই পড়তে হবে। অন্যান্য সাবজেক্ট বাংলায় চাইলে বাংলায়, ইংরেজি চাইলে ইংরেজিতেই পড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাটা ইংরেজিতে পড়ানো হয় না।
মহিলা শুনে একটা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে “ওহ!” বলে চুপ করে গেলেন।

আমার কৌতূহল হলো। জানতে চাইলাম - “কেনো ইংলিশ মিডিয়াম দিয়ে কি হবে?”
সঙ্গে সঙ্গে উনি ওনার ওই তিন চার বছরের মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।”
“কোন স্কুল?”
বললেন, “ওই যে সামনেই সেন্ট ম্যাথুজ।”
তাঁর উচ্চারণ অনুযায়ী ওটাই বুঝেছিলাম। পরে ওই স্কুলের একটা ব্যানার আমার কলেজের উল্টোদিকে দেখেছি। আমি ওহ বলে চুপ করে রইলাম, স্কুলটা আমার আজও অজানা। একটু পরেই তিনি নেমে গেলেন। তারপর আমি একা তাঁর কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কলেজে পৌঁছে গেলাম। ভাবলাম -- ওহ কলেজটা ইংলিশ মিডিয়াম হওয়া উচিত ছিলো।

তিনি বা তাঁর মতো অনেকেই বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম বা হিন্দি মিডিয়াম যেখানেই পড়ান না কেনো, সেটায় আমার কিছু এসে যায়না। আমার কোনো বক্তব্য নেই, থাকা উচিতও নয়। কিন্তু কলকাতায় থেকে বাংলা ভাষার ওরফে মাতৃভাষার প্রতি সবার এতো নাকউঁচু ভাব দেখে আর চারদিকে ইংরেজি শুনে শুনে নিজের একটু হতাশ লাগে। ভাবি, ছোটোবেলাটা বুঝি ইংলিশ মিডিয়ামেই কাটানো উচিত ছিলো, বা যতটুকু ইংরেজি শিখেছি সেটা বুঝি কলকাতার জন্য যথেষ্ট নয়। এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে একবার মনে হলো, এই ভাষার সঙ্গে পরিবেশের তাল রাখতেই বুঝি "দিদি" কলকাতাকে লণ্ডন বানাতে চাইছিলেন। কিন্তু সফল হননি দেখে একটা সোজা পথ বের করলেন। শেষে বাংলায় বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করে দিলেন।
এই প্রসঙ্গে আমার আরও একটা ঘটনা মনে পড়লো। আজ থেকে বছর পাঁচ আগের কথা। তখন অন্য একটা বাড়িতে। একদিন আমি দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। কমপ্লেক্সের নিচে অনেক বাচ্চা খেলছিলো। তাদের মধ্যে দুজন দৌড়ে এসে আমার সঙ্গে লিফটে উঠলো। তারা দুই ভাই। মুখ চিনতাম। একজন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স, অন্যজন থ্রি বা ফোর -- ঠিক মনে নেই। লিফটে তারা তাদের ফ্ল্যাল্টে যাওয়ার বোতামটা টিপেই আমাকে বললো, “আন্টি তোমারটা কত?”
বললাম, “এগারো।”
সঙ্গে সঙ্গে দুই ভায়েই অবাক হয়ে চোখ মুখ বেশ কুঁচকে বললো, “মানে? এগারো মানে?!”
বললাম, “ওহ তোমরা বাংলা জানোনা? ইলেভেন।”
দুই ভায়েই বেশ খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে শুরু করলো, “না আমরা বাংলা জানিনা। আমাদের স্কুলে হিন্দি আর ইংলিশটা শেখায় ওটা আমরা ভালো জানি। লিখতে পড়তেও পারি।”
বললাম বাড়িতে মা বাংলা শেখায় না?
বললো, “শেখাতো আমাদের ভাল্লাগেনা।”
বললাম, “বাংলায় কথা তো দিব্যি বলছো।”
বললো, “হ্যাঁ কথা বলতে পারি কিন্তু লিখতে পড়তে ভাল্লাগেনা।” বলে তারা আমার আগে লিফট থেকে নেমে গেলো।
আমি হালকা করে বলার চেষ্টা করেছিলাম, “বাংলাটা শিখে নিও!”

ভাষা একটা মাধ্যম। যেটা মনের ভাব প্রকাশ করতে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে এমনকি চিন্তা করতে সাহায্য করে। একটা বাচ্চা যে বাংলায় কথা বলে, ইংরাজি আর হিন্দিতেও তুখড় সে কি করে "এগারো" কথাটায় থমকে যায়? তাহলে সে চিন্তাটা কোন ভাষায় করে? অনেক ভাষা জানা মানে তো গর্বের কথা। তাহলে এই ছেলেটির গর্ব কাকে নিয়ে? জানিনা। অনেক প্রশ্ন মাথায় কামড়ায়, উত্তর পাইনা। হয়তো সে একদিন এগারো কথাটা শিখে যাবে, আমারো হতাশা দূর হবে।

অনেকেই ভাবতে পারে, নিজের ছেলেকে তো বাবা ইংলিশ মিডিয়ামেই দিয়েছো, তাতে আবার বড় বড় কথা কিসের! একদম সত্যি কথা ইংলিশ মিডিয়ামের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তাই বলে ছেলে বাংলা শিখবে না এটা হতে পারে না। আমি নিজে বাঙালি, বাংলা ভাষাতেই লিখে, পড়ে, গল্প করে, হেসে, কেঁদে আনন্দ পাই। আমার সাবজেক্টও বাংলা। তাই ছেলে যাতে বাংলা শেখে তার প্রচেষ্টা আমি বাড়িতেই করি। সে মাঝে মাঝে ডায়রি লেখে। অধিকাংশ সময়ে তাতে স্কুলের কোনো একটা ঘটনা দু-লাইনে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত