জীবনের মানে

গ্রামে গিয়ে এখন আর ঘুরে বেড়ানো হয়না। একদিনের জন্যে যাই। গিয়ে রেস্ট নিতে নিতেই ফেরার সময় এসে যায়। এবারে একটু নিজেকে মোটিভেট করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।  


এখন অনেক নতুন মুখ উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, আমিও তাদের। কোনো কোন ছেলেমেয়ে, বউকে জিজ্ঞেসও করি, “তুমি কে?” “তোমার বাবার নাম কি?” “তুমি কার বউ?” পরিচয় দিলে বুঝি। কারো বা মুখ দেখেই বুঝে যাই। আমাকেও কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে। এবারেই একজন বউ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে গো? তোমাকে কখনো দেখিনি তো তাই জিজ্ঞেস করছি।” নিজের পরিচয় কিভাবে দেবো বুঝে উঠতে না পেরে, এক কাকীমাকে বললাম, “কাকীমা আমি কে, একটু বলে দাও।” কাকীমা বলে দিলো, সেইসঙ্গে জানতে চাইলো আমি তাকে চিনি কিনা। বললাম, চিনি না। তখন কাকীমা তারও পরিচয়ও দিলো।


কিন্তু তার একটু আগে আমি ওই বউটাকে খুব ঝগড়া করতে দেখে তার মুখের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাই সে আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিলো।


একদল বাচ্চা সরস্বতী পুজোর জন্যে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকে চাঁদা আদায় করছিলো। সেখানে বাচ্চাদের মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। বাচ্চাদের মধ্যে ওই বউটার বাচ্চাও ছিলো। তাই সে এসে তার বাচ্চাকে খুব শাসন করছিলো। এমন বাজেভাবে বকছিলো, আমি দাঁড়ালে সে যাতে লজ্জা পেয়ে থামে, তাই দাঁড়িয়ে গেছিলাম। কিন্তু থামেনি।


তারপর বেশ কয়েকজনের বাড়ি গেলাম। আমাদের ছোটোবেলার মাঝবয়েসী কাকা কাকীমারা এখন কাঁচা-পাকা চুলের দাদু দিদা। কারো কারো দাঁতও গেছে পড়ে। আমাদের যারা ঠাকুমা জেঠিমা ছিলো তারা এখন পুরো সাদা চুলে, খোলা রোদপিঠ। অনেক কথা, অনেক গল্প, কিছু খাওয়া-দাওয়া সেরে যাদের বাড়ি ঢুঁ না দিয়ে ফিরতে পারলাম না, সে তারা আমার এক কাকা-কাকী।


ছোটবেলা থেকেই খুব ভালোমানুষ বলে যাদের চিনেছি তারা এই হতদরিদ্র কাকা - কাকী। আমরা গোপালকাকা - গোপালকাকী বলেই ডাকি। চালচুলোহীন মানুষ দুটোর জীবনে একে অপরকে ভালোবাসা ছাড়া আর মনে হয় কিছুই নেই।


আমি যেতেই আমাকে দেখে প্রথমে আনন্দে কেঁদে ফেললো। তারপর শুরু করলো তাদের জীবনের কাহিনী। আমার বাবা হতেই নাকি তাদের এই গ্রামে থাকা। আর এক জেঠুর নাম বললো, সে বাড়িটা করতে জায়গা দিয়েছিলো। আগে কাকা - কাকীমা খুব কষ্ট করে, লোকের বাড়ি কাজ করে, মুড়ি ভেজে দিন চালাতো। গ্রামের সব মানুষ তাদের এতো ভালোবাসে, তাই সবাই কিছু না কিছু খাবার তাদের সবসময় দেয়।


আমি ছোটবেলায় দেখেছিলাম, কাকা কাকীমা দুজনেই তাঁত বুনতো। কাকা গান আর তবলা বাজানো শিখিয়েও কিছু রোজগার করতো। তার আগে যাত্রাদলে গান করতো। দুই মেয়ে। কষ্ট করেই তাদের বিয়ে দিয়েছিলো। আমি দেখতাম কাকারা খুব বিকেলে ভাত খেতো। চারটে পাঁচটার সময়। জিজ্ঞেস করতাম, এতো দেরি করে খাও কেন? তখন বলতো, আমরা সারাদিনে একবার খাই তো, তাই যতটা পারা যায় বেলা করে খেলে আর রাতে খেতে হয় না। খুব ছোটবেলায় ভাবতাম এটা ঠাট্টা।


কাকা অনেক কিছুই পারতো। আমি তাকে কোনোদিন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে দেখিনি। আমাদের পুকুরে চান করার শেষে বহুক্ষণ ধরে পৈতে পরিষ্কার করে, সূর্য প্রণাম শেষে হাত দিয়ে চুল আঁচড়াতো। চিরুনি ছাড়া এতোটাই পরিপাটি চুলের পাট, সেটা না দেখলে বোঝার ক্ষমতার বাইরে। অনেক পশুর ডাক নকল করতে পারতো। আমি কাকাকে দেখতে পেয়েই বলতাম, একবার কুকুর চেঁচাও। কাকা আমার আবদার মেটাতো। এবারে আমি যাওয়ার পর একটু দূর থেকে লাঠি ধরে ঠুকঠুক করে বাড়ি ফিরলো। এসে আমার থুতনি ধরে আদর করে বললো, মা আমার একদম মেমসাহেব। দাঁতগুলো সব পড়ে গেছে। চোখে বিশাল পাওয়ারের চশমা। বাঁহাত কাঁপছে। বাঁপায়েও কোনো বল পায় না। তবুও নুয়ে নুয়ে খড়ের একটা ঝাঁটা দিয়ে ঘর, বিছানা সব ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে এসে আমার বাবা, জেঠু, গ্রামের অন্যান্যদের গল্প শোনালো।


কাকীমা অনেক লম্বা। কাকার থেকেও। বহুদিন আগেই তার কোমর পড়ে গেছে। দারিদ্রের ভারে নাকি দৈর্ঘের ভারে জানি না। মাঝে মাঝে যন্ত্রণা চেপে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করার চেষ্টা করছিলো। আমার কাছে গোপালকাকী মানে -  সাদা লাল পাড় শাড়ি, কপালে লাল সিঁদুরের বড় টিপ, চওড়া সিঁথি, ভর্তি সিঁদুর আর অমলিন হাসি। কাকীমা বারবার বলতে লাগলো, তারা গরীব হলেও কতটা সুখী। আনন্দ করে বাঁচে তারা।


এখন মানুষ নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। তাই তাদের ধৈর্য কম, অল্পেই ভেঙে পড়ে হতাশায় ভোগে। কেউ কেউ আবার হতাশা নামক বিলাসিতার দোহাই দিয়ে কি কি করতে পারে সেটাও ২০১৭ আমাকে দেখিয়েছে। প্রকৃত লড়াই বলতে যা বোঝায় তা আজকালকার মানুষের জন্যে নয়। আমি ছোট থেকেই এই চালচুলোহীন মানুষের লড়াই করে বাঁচা দেখেছি, তাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা যেমন অটুট তেমনিভাবেই অটুট তার চার পাশের মানুষগুলোর জন্যেও। চালচুলো না থাকলে তারা কোনো দল গড়ে না, তাদের নিয়ে কেউ দলাদলি করে না। তাই আজও সবাই তাদের খুব ভালোবাসে। তাদের জন্যে খাবার রান্না করে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।

২০১৭য় আমার অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয়েছে। সব অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মতো নয়। তবুও বছরের শেষদিনে আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা গোপালকাকা - গোপালকাকী ভালো আছে জেনে খুব আনন্দ পেয়েছি। অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি। আবার যখন যাবো তোমাদের সঙ্গে গল্প করে আসতে চাই। তোমরা অন্তত দুজনে দুজনের জন্যে ভালো থাকো।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত