এক টুকরো মহানগর

ডানলপ থেকে উবেরে চড়ে বসেছিলাম। রবীন্দ্র ভারতী বাসস্যান্ডে গাড়ি বাঁদিকে দাঁড়িতে গেলো। আমি ভাবলাম পুলিশের কেস খেয়েছে বুঝি। কিন্তু তা নয়। দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক উবেরের কাছে এগিয়ে এলেন। উবেরওলা একগাল হেসে বললো, “এদিকে এখন আপনি? বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি এই তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কোথায় যাচ্ছো এখন?” উবেরওলা বললো, “ওই সুলেখা আছে।”

তারপর কি কথা হলো খেয়াল করলাম না, নিজের খেয়ালেই ছিলাম। আরো কিছুটা এসে আমি বললাম, “বাঁদিকের জানলার কাঁচটা একটু তুলে দেবেন? ঠাণ্ডা লাগছে।”

-- “হাঁ হাঁ দিচ্ছি। আসলে উনি আমার মালিক। তাই কথা বলছিলাম।”
-- “মালিক?”
-- “হাঁ, আমার মালিক আছে।”
-- “উনি গাড়ি কিনে উবের হিসেবে ভাড়া দিয়ে নিজে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে?”
-- “হাঁ, উনি পাব্লিক টান্সপোটে যাতায়াত করেন, মেট্টো, বাস, টেন।”
-- “বাব্বা।”
-- “হাঁ, উনি খুব ভালো। উনি পড়ান। যাদবপুরে, রবীন্দ্র ভারতীতে, এখন আবার ডানলপে আছে। তিন জায়গায় পড়ায়।”  
-- “কি পড়ান? এমন তিন জায়গায়?”
-- “ওই যারা জপে আছে তাদের পড়ায়।”
-- “জপে মানে?”
-- “জপে মানে, ওই কলেজ শেষ করে যারা জপ খুঁজছে তাদের।”
-- “ও আচ্ছা। জবের চেষ্টা করছে যারা?”
-- “হাঁ হাঁ। জব করবে যারা।”
-- “বুঝেছি, তার মানে কোনো কোচিং ইন্সটিটিউটে পড়ায়।”
-- “হাঁ, আবার পাইভেট কোচিং সেন্টার ভি আছে।”
-- “কি সাবজেক্ট?”
-- “ওটা বলতে পারবো না ম্যাডাম। আপনি যদি জানতে চান, জেনে বলতে পারি।”

নিজে সম্বিত ফিরে, হাঁ হাঁ করে উঠে বললাম, না না তার দরকার নেই, আমি জাস্ট এমনি বলছিলাম, আপনি জানেন কিনা সেটা জানতে।

উবেরওলা ওনার নাম, বাড়ির ঠিকানা সব বলে দিলেন।

-- “উনি খুব ভালো মানুষ ম্যাডাম। আমি ওনাকে ভগয়ান পেয়েছি। আমার মনের সঙ্গে ওনারও মিল হয়। দুজনেই কোনো উল্টাপাল্টা নেশা করি না। আমি গাড়িও খুব ভালো চালাই। খুব মেহনত করি। উনি আমাকে লস করে টাকা দিতেন। তবু কিছু বলতেন না।”
-- “কত টাকা পান আপনি?”
-- “আমি পার টিপ পঞ্চাশ টাকা নি। আগে ষাট ছিলো।”
-- “হ্যাঁ, আমারো তাই মনে হচ্ছিলো, কারণ আগে এক উবের ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি ষাট বলেছিলেন।”
-- “হাঁ, ইনিও ষাট দিতেন। কিন্তু আমি বুঝেছি উনার খরচ বেশি হয়ে যেতো। উনার পকেট থেকে টাকা যেত। আমার আয় বেশি হতো তার থেকে। আমি গ্রামে যাওয়ার সময় বলে গেছিলাম, আপনি আমাকে পার টিপ পঞ্চাশ টাকা করে দিবেন, যদি পঞ্চাশ করে দিবেন তো বলেন গাড়ি চালাবো, না হলে চালাবো না। উনারও আমাকে পছন্দ। তাই বললেন, ঠিক আছে তাই দেবো। তুমি ছেড়ে দাও এটা আমি চাই না। তারপর থেকে এসে আবার চালাই। উনি মানুষ ভালো আছেন ম্যাডাম। ভগয়ান। আমি যখন গ্রামে যাই তখন আমাকে এমনিই কতকি দিয়ে দেয়।”
-- “কি দেয়?”
হেসে হেসে, “এই মেয়েটাকে একটা জামা দিয়ে দিলো, বউটাকে শাড়ি দেয়, কখনো আবার হাজার টাকা দিয়ে বলেন, গ্রামে যাচ্ছো মিষ্টি ফিস্টি কিনবে।”
-- “ওনার বাড়িতে কে আছে?”
-- “উনার একটা মেয়ে আছে, তেরো চোদ্দ বছরের, আর বউ আছে। মা আছে। মাকে তো বোনের বাড়িতে রাখতে হয়েছে, বউয়ের সঙ্গে মিলে না। তাই মা থাকে না। উনি ভালো মানুষ।”  
-- “আপনার বাড়িতে কে আছে?”
-- “আমার এখানে কেউ নেই, সব গ্রামে আছে। আমার একটা ছেলে, একটা মেয়ে, বউ আর মা-বাবা। আমি তো মা-বাবার জন্যে বউকে এখানে আনতে পারি না। ওদের কে দেখবে?”  
-- “ও। ছেলেমেয়ে কত বড়?”
-- “ছেলে ষোলো বছরের, মেয়ে নয়।”
-- “পড়াশুনা করে?”
-- “হাঁ ম্যাডাম। পড়াশুনা করে তো। ছেলে আমার খুব ভালো আছে। ওই গ্রামে সবেতেই ফাস্ট ডিবিশন পায়।
কোন ক্লাস? ষোলো যখন মাধ্যমিক দিয়ে দিয়েছে তো?”
-- “না ম্যাডাম। নয় ক্লাস চলছে। ছেলেটা যখন ছোট ছিল, তখন খুব অসুক করেছিলো। হয়েছিল কি, সব জয়েনে জয়েনে ব্যথা। হাত দুটো পুরো এইভাবে বেঁকে মুড়ে গেছিলো। বলে দেখালেন।”
-- “এবাবা! তারপর?”
-- “তারপর অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। একবার বেনারসে বাবা রামদেবের ক্যাম্পেন চলছিলো, ওখানে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন একজন লোক দেখে বললো, তুমি অমুক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। তোমার ছেলে পনেরো দিনে ফুটবল খেলবে। ডাক্তারকে রোগের নাম বলবে না, সে নিজেই বুঝে যাবে। আমি বিশওয়াস করে নিয়ে গেলাম ম্যাডাম। তারপর সত্যিই তাই হলো।”  
-- “কে ডাক্তার? নাম কি?”
-- “একজন মুসলিম হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছে ম্যাডাম। নাম বাহাদুর। বেনারাস থেকে চল্লিশ কিলোমিটার ভিতরে। থাকার জন্যে হোটেল, হস্পিটালও হয়ে গেছে। যেকোনো বিমারী হলেই ভালো হয়ে যায়। আমি নিয়ে গেলাম, চোখ বন্ধ করে আমার ছেলের নাড়ি দেখে ওষুধ লিখে দিলো পনেরো দিনের। তেরো দিনেই ছেলে ভালো হয়ে গেলো। তারপর ডাক্তার আবার চেক করে বললো, এই ওষুধ দু বছর চলবে। তাই তখন স্কুলে দিইনি। ওর মা বাড়িতে পড়াতো। তারপর একবারে ফাইভ ক্লাসে দিয়েছিলাম। তখন থেকেই সবে তে ফাস ডিবিশন পায়। খুব ভালো ছেলে আছে। পড়াশুনা করে। আমিও পড়াশুনা করেছি, ম্যাট্টিক দিয়েছি, ইন্টারটাও পাস করেছি। ইংরেজি রিডিং পড়ে দিতে পারবো, কিন্তু মিনিং করতে পারবো না। কিন্তু এটা মহানগর আছে। এখানে তো এই পড়ায় চাকরি পাওয়া যায় না। তাই গাড়ি চালানোটাই শিখলাম। আমার কাকা আমাকে এখানে এনেছিলো।”
-- “কত বছর এসেছেন কলকাতায়?”
-- “হুম, বছর ষোলো হলো।”
-- “আগে কি করতেন?”
-- “আগে গাড়ি শিখে ওই পাইভেট গাড়ি চালাতাম। তারপর উবের এলো, তখন উবের শুরু করলাম। অনেক ডাইভারই উবের ধরে নিয়েছে।”  
-- “কেন? প্রাইভেটে ভালো মাইনে তো?”
-- “ভালো কোথায় ম্যাডাম? খুব বেশি হলে বারো। আর আমি উবেরে তো কুড়ি হাজার করে পাই। আমি খুব মেহনত করি। কাল তো আঠারোটা টিপ দিয়েছি।”
-- “আপনার খরচ কেমন?”
-- “এখন ছ-সাত হাজার করে খরচ হয়। ডেলি দুশো টাকা।”
-- “বাড়ি ভাড়া?”
-- “বাড়ি ভাড়া আটশো, ইলেকটিক বিল নিয়ে হাজার হয়ে যায়। আর বাড়িতেও খরচ দি। আগে জয়েনে থাকতাম। ভাই আলাদা হয়ে গেছে। খরচ দেয় না। বাবা বলেছে তিন মেয়ে, বউ একটাও টাকা না দিলে কি করে হবে? আর ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে মায়ের খিচিমিচি হতো। তাই আলাদা হয়ে গেছে।”
-- “ও। আপনি কতদিন অন্তর গ্রামে যান?”
-- “এই তিন চার মাস অন্তর চলে যাই। ছটে যাই, হোলিতে যাই। মাঝে মাঝেই চলে যাই।”
-- “চাষবাস করেন?”
-- “আমি করতে পারি না, শিখিনি। বাবা করে। বাবা আবার ইঁটের চিমনির মুন্সী আছে। দশ হাজার টাকা করে আয়ও করে। ওতেই চলে যায়।”
-- “গ্রামে আমাদের মাটির বাড়ি আছে ম্যাডাম। চারটে ঘর। আবার ইঁটের বাড়ি করছি। কিন্তু বালু পাওয়া যাচ্ছে না বলে, অর্ধেক হয়ে বন্দ আছে।”
উনি বাড়ি তৈরির গল্প বলছিলেন, আমি সেটা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলাম “বালু কি?”
-- “ওই সিমেন্ট, বালু হয় না?”
-- “ও আচ্ছা আচ্ছা। বালি।”
-- “হাঁ বালি। ওই শন নদী থেকে তুলে বিক্রি করে। এখন G S T ফি এস টি হয়ে সাপ্লাই বন্দ হয়ে গেছে। খরচ বেশি। সাধারণ মানুষ কিনবে কি করে?”
-- “ও তাহলে তো খুব মুশকিল।”
-- “হাঁ, এই সরকার তো যা করছে, তাতে তো আমাদের মতো মিডিল ক্লাস মানুষ ফেঁসে যাচ্ছে। দেশের ভালো করতে চাইছে, ভালো কি হচ্ছে? সবাই তো ফেঁসেই যাচ্ছি। তবে নেতারা কেউ ভালো না, সবাই সমান। কাউকে ভালো বলা যাবে না।”
-- “হুম।”

গল্প চলতে চলতেই আমার বাড়ি এসে গেলো। নামলাম। মনে হলো, মালিক কর্মচারীর মধ্যে এমন সুন্দর সহযোগীতার সম্পর্কও হয়। মালিককে ভগয়ান ভাবা মনে হয় না খুব সহজ কথা।

এভাবেই বেঁচে থাকুক মহানগরের সমস্ত সুস্থ সম্পর্ক।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত