কাঠবিড়ালী

বৃষ্টিভেজা দিন। অলস মন। হাবিজাবি জিনিস মাথায় ভিড় করছে। তার মধ্যেই হঠাৎ মনে এলো, ‘ফজলো গয়লা’ কথাটা। এটা একটা নাম। হ্যাঁ, আমার বড়জেঠুর ডাকনাম ফজলো, আমরা জাতিতে গয়লা। লোকে ফজলো গয়লার ভাইঝি বললে খুব রাগ হতো, লজ্জাও পেতাম। পরে নামটা ভেবে মনে মনে হাসতাম।

যদিও শোনা যায়, কৃষ্ণ গয়লার বাড়িতে জন্মেছে, তবুও আমার দিদিশাশুড়ির গয়লায় মেয়েতে একটু আপত্তি ছিলো। জাত জিজ্ঞেস করাতে আমার অধার্মিক বর যখন সেটা বলার প্রয়োজনই মনে করেনি, তখন তিনি হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন -- হ্যাঁ রে তবে কি গয়লা?? যাকগে সেসব অন্য প্রসঙ্গ। সে আর একদিন হবে খন।
বড়জেঠুর নাম গণেশ, মেজোজেঠুর নাম কার্তিক। তখনকার দিনে শ্বশুর, ভাসুর, বরের নাম ধরে ডাকতে নেই বলে কত ভালো ভালো নামই এমন বেঘোরে বাজে নামে পরিণত হয়ে গেছে। এইভাবেই গণেশ চন্দ্র ঘোষ - ফজলো গয়লা হয়ে গেছিলো।  

আমার মা’ও ঠাকুমাদের পথ অনুসরণ করে বড়দের নাম না বলা অভ্যেস করেছিলো। খুব দরকারি কাজে, হয়তো আদমশুমারিতে বাড়ির সবার নাম বলতে হবে, বা পুজোর সময় নামগোত্র বলতে হবে, তখনো আকার ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিতো।

বড়জেঠুকে বোঝাতে গিয়ে বলতো পেট বড় বা পেটনাদা ঠাকুর। মেজোজেঠুকে বোঝাতে গিয়ে বলতো আশ্বিনমাসের পরের মাস বা আঁধারে মাস। বাবার নাম নবকুমার। সেটা হয়ে যেতো নতুন জিনিস। ঠাকুমার নাম লীলাবতী। সেটা বোঝানোর উপায়টা বেশ অভিনব। কৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে যা করতো তাই!! বোঝো এবার। কারো যদি জানা না থাকে, কৃষ্ণ কি করতো! ঠাকুমার ভাইয়ের নাম অজিত। মায়ের মামাশ্বশুর।  যথারীতি তার নামও উচ্চারণ করতে নেই।

একবার পাড়ার এক দাদু এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। ভালো ভালো কাপ বের হয়েছে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা কে এসেছিলো বাড়িতে? মা উত্তর দিয়েছিলো, “ওই তোর জয়কৃষ্ণপুরের দাদুর নামে ঘোষদাদু।” কি বিড়ম্বনা! মা কখনোই এই  নিয়ম মানতে ভুলতো না। অবাক হতাম।

এইসব গুরুজনের নামে যদি কোনো জায়গার নাম হয়, সেগুলোও বলতো না।  আমাদের ওদিকে গণেশপুর বলে একটা জায়গা আছে, মা সেটা বলে, তোর বড়জেঠুর নামে ওইপুর। কার্তিকপুজোকে বলে আঁধারপুজো।

বড়দাদুর নাম ছিলো পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। বড়ঠাকুমা, ঠাকুমা থেকে শুরু করে মা বড়মা কাউকে আজ অব্দি ‘পূর্ণিমা’ কথাটা বলতে শুনলাম না। যাদের পুত্র সন্তান থাকে তাদের মঙ্গলের জন্যে নাকি পূর্ণিমা করতে হয়। সবারই ছেলে আছে, তাই সবাই পূর্ণিমাতিথি পালন করতো। আমরা পাছে কোনো অনিয়ম করে ফেলি, তাই আগেরদিন থেকেই আমাদের মগজ ধোলাই করা হতো - কাল কিন্তু বড়চাঁদ আছে। কোনো সকড়ি, এঁটোকাঁটায় হাত দিয়ে যেন সব একসা না করি।

প্রথম প্রথম বুঝতে খুব অসুবিধা হতো, বড়চাঁদ আবার কি? আর বড়চাঁদ যদিইবা হয়, সে তো থাকবে আকাশে। পরে বুঝে গেছিলাম।

ঠাকুমাও অমন দাদুর পূর্বপুরুষদের নাম মেনে চলতো। তবে কৌশলটা একটু আলাদা ছিলো। মা’র মতো ব্যাসবাক্য না করে বর্ণের বিপর্যয়। ননীলালকে বলতো ফনীলাল, বনমালীকে - ফোনোমালী। নৈতালকে - ফৈনিতাল!! ছোটঠাকুমা বলতো, “ফৈনিতালের নতুন আলু।”

আমার দাদুর নাম সাধন, দাদুর ভাইয়ের নাম সুধীর। দাদু অনেক আগেই মারা গেছে, বাবার দুবছর বয়সে, ফলে তার কথা আমাদের মাথাতেই আসতো না। দাদু বলতে আমরা সুধীরদাদুকেই বুঝি। কিন্তু আমাদের নাপিতের নাম সাধন, নিতাই, বিশ্বনাথ। কিন্তু কোন নাপিতের কাছে যাবো বা কাকে ডাকবো জিজ্ঞেস করলে, যদি বলতো, ‘তোর দাদুর নামে’, তখনো একটু মুশকিলে পড়ে যেতাম।

আমার মায়ের নাম আরতি। আমার বৌদিরা দুর্গাপুজোর সময় প্রথম প্রথম আমাকে বলতো, “ওই? মায়ের নামে ওটা দেখতে যাবে?” হাঁ করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

নব আনন্দে জাগো, আগুনের পরশমণি গানে যেখানে “নব নব” কথাটা আছে এমন অনেক গান আমার মা, ওই “নব’র” জায়গাটা গুণগুণ করে শুধু সুরের ওপর ছেড়ে দিতো।

কাল আমার বোনপো আপন মনে খেলতে খেলতে বলে চলেছে, এটা রূপশ্রীর, এটা পুপুনের, এটা শ্রেয়সীর। আর বোন তাকে বকছে, এই নাম ধরে ডাকছিস কেন? সব তোর সমবয়সী নাকি? আমি শুনে বললাম, বকছিস কেন? কি মিষ্টি লাগছে ওর মুখে শুনতে। বাব্বা! ওই মা - ঠাকুমাদের নিয়মে নাম দিতে গেলে আমার নামের কি যে, হাল হতো কে জানে!! এমনিতেই আমার নামটা আমার পছন্দ নয়।

রুহান আমার হাজারটা নাম দিয়েছে। এবেলা ওবেলা নাম পাল্টে যায়। এখন আমার নাম কাঠবেড়ালী। ঘুম থেকে উঠে কাঠবেড়ালী বলেই আমাকে আদর করে দিয়েছে।

ভাগ্যিস আমি এই নিয়মের ধার ধারি না। তাহলে আমার বরকে হয়তো “হনুমান” বলেই ডাকতে হতো। কারণ শ্বশুরমশায়ের নাম পবন না হলেও, শাশুড়িমা’র নাম তো অঞ্জনা। ;-)

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত