মহিলা কামরা - ৬
স্টেশনে পৌঁছে দেখি বেঞ্চটা ফাঁকা নেই। দুটো মোটে সিট। এই জনবহুল দেশে সিট পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। তাই একটু এগিয়ে ব্যাগটা একটা কাঠের বাক্সের উপর রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর স্কুলের তিন দিদিমণি একসঙ্গে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।
এক দিদিমণি শুরু করলেন, “অমৃতাদি কটা খাতা দেখলে?”
অমৃতাদি বললেন -- “আটটা।”
-- “যাক উন্নতি হয়েছে। সাড়ে তিনটে থেকে আটটা।”
আরো এক দিদিমণি জিজ্ঞেস করলেন -- “অমৃতাদি তোমাকে কটা জমা দিতে হবে যেন? পনেরোটা?”
অমৃতাদির গলায় বেশ বিরক্তি। “হ্যাঁ, মিনিমাম তো পনেরোটা। ম্যাক্সিমাম সবগুলো।”
-- “হ্যাঁ হ্যাঁ, পনেরোটা না হলে তো তুমি ওই ফর্মটা ফিলাপ করতে পারবে না।”
প্রথমজন আবার বললেন -- “শোনো, তার বেশি দেখা হয়ে গেলেও কিন্তু তুমি পনেরোটাই দিও তার বেশি দিও না। আমি একবার করেছিলাম। আমাকে পঞ্চাশটা খাতা দেখতে দিয়েছিলো, প্রথমে তিরিশটা জমা দিতে বলেছিলো, আমি তিরিশটাই জমা দিয়েছিলাম। বাকিগুলো নিয়ে যাইনি। জমা দিতে গিয়েছিলাম যখন তখন আমাকে বলেছিলো, ‘আপনাকে তো এবারে কম খাতা দেওয়া হয়েছে, আরো কিছু দি?’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘না না ম্যাডাম বাড়িতে বাকিগুলো এখনো দেখা হয়নি, তার ওপর আমার বাড়িতে একটু ঝামেলাও আছে।’ ”
এমন অভিনব পরামর্শ দিতে পেরে তাঁর মুখে আত্মতৃপ্তির মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
অন্য দিদিমণি বললেন, “আমরা কি সব কু-পরামর্শ দিচ্ছি তাই না?” বলে হাহা করে হাসতে শুরু করলেন।
অমৃতা দিদিমণি ফোন করছিলেন। অন্য দিদিমণিরা জিজ্ঞেস করলেন, “সকাল সকাল কাকে এতো ফোন করছো বলো তো?”
-- “আঁকার স্যারকে।”
-- “ও! কি ব্যাপার? কাল থেকে এতো আঁকার স্যারকে ফোন করতে ব্যস্ত?”
ওনারা মজা করতে চাইলেন। কিন্তু অমৃতা দিদিমণির সমস্যা ছিল গুরুতর, তিনি সত্যি সত্যি সেটা বলতে লাগলেন।
তারপর আজকের হিউমিডিটি নিয়ে গল্প শুরু করলেন ওনারা।
ট্রেন আসতে দেখে আমরা এগিয়ে এলাম। ট্রেন হঠাৎ প্ল্যাটফর্মে ঢোকার একটু আগে দাঁড়িয়ে গেলো। এক দিদিমণি বললেন, “সিঙ্গেল পায়নি, তাই দাঁড়িয়ে গেলো।” আমি ভাবলাম শব্দটাই ভুল শুনলাম বুঝি। তারপর দেখলাম আর এক দিদিমণি বললেন, “ওই ডবল পেয়েছে, আবার আসতে শুরু করলো।” বুঝলাম ভুল শুনিনি। এই স্থূল জোক হয়তো কাউকে নকল করেই।
ট্রেন এলো। আমি অমৃতা দিদিমণির পিছু পিছুই উঠলাম। উনি আরো কি বলেন সেটা শুনে লিখবো বলে। কিন্তু ওনার সঙ্গীরা ওনাকে চিৎকার করে ডেকে নিলেন, ওদিকে জায়গা আছে বলে। উনি চলে গেলেন। আমার পাশে অন্য এক দিদিমণি ছিলেন।
পরের স্টেশনে সামনের সিটটা ফাঁকা হতেই আমার ডানদিকে বসা একটা মেয়ে উঠে রেডি হচ্ছিলো ওই সিটটায় বসবে বলে। কিন্তু আমার বাঁপাশে বসা দিদিমণি ঝপাং করে উঠে ওটায় বসে গেলেন। তিনি মোবাইল দেখতে ব্যস্ত ছিলেন, তাই একটু পরে বুঝলেন মেয়েটা ওটায় বসতে চাইছিলো। তাই সঙ্গে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি বসতে চাইছিলেন? বসবেন? সরি আমি বুঝতে পারিনি।”
মেয়েটা বললো, “না না ঠিক আছে আপনি বসুন।”
আর একটা স্টেশন এলো। সামনের দরজা দিয়ে কিছু মহিলা, পিছনের দরজা দিয়েও অনেক মহিলা উঠলেন। সামনের দরজা দিয়ে উঠে এক মহিলা আমার সামনের সিটের চার নম্বর যাত্রী হতে যাচ্ছেন, প্রায় বসে পড়বে এমন অবস্থায়, মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো এক মাঝবয়সী মহিলা দৌড়ে এলেন, এবং সামনের সিটের আইল চেয়ারে বসা মহিলা সরে গিয়ে তাঁকে জায়গা দিলেন। দিয়ে অন্য মহিলার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিলেন। মাঝবয়সী দুই মহিলা বন্ধু। ওই মহিলা তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে জাস্ট বললেন, “এটা আপনার সঙ্গে হলে কেমন হতো?” বলতেই, যিনি এসে বসলেন তিনি তড়াক করে উঠে, “ও আপনি বসতে চান? বসুন, প্রবলেম কোথায়? বসুন বসুন।” বলে প্রায় ঝগড়ার মুডে চলে গেলেন।
অন্যদিকে দিদিমণি মোবাইলটা চোখ থেকে একটু সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “উনি যেটা করলেন, ঠিক করেননি। কালচার শেখা দরকার।”
ব্যাস! আবার সেই, খাক তাতে দুঃখ নেই ওলো বলবে কেন!
এবার সেই মহিলা প্রায় যুদ্ধংদেহী হয়ে শুরু করলেন, “হুম! কালচার শেখাতে হবে? কালচার তোমরা শেখো। বলেই উঠে বললেন নাও তোমরা রিলাক্স করে বসো। আমরা আনকালচার? তোমরা যত কালচার শিখে এসেছো? যাচ্ছো তো ওই রুরাল প্লেসে পড়াতে। ঢুকবে একটা জায়গায়, গিয়েই তো ষাঁড়ের মতো চেঁচাবে। কালচার শেখাচ্ছে। যত্তসব মুসলিম বাচ্চাদের নিয়ে কারবার। পড়াতে সাউথ পয়েন্টে, বুঝতাম। রুরাল প্লেসে যাচ্ছে আবার বড় বড় কথা।”
তিনি দরজার কাছে গিয়ে একতরফা চিৎকার করেই চললেন।
এর মধ্যেই অনেক কালো কালো প্যাকেট হাতে এসে গেলো লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরা, দাড়িওলা এক ফেরিওয়ালা, কাঁধে একটা বড় ব্যাগ। ওই মহিলার গলার আওয়াজকে ছাপিয়ে জোরে জোরে বলতে থাকলো, “কালো মাণিক আছে, কালো মাণিক। দাঁত ভালো রাখতে, দাঁতের গোড়া মজবুত রাখতে, মুখের পচা দুর্গন্ধ দূর করতে হাতটা বাড়িয়ে একবার প্যাকেটটা নিন। দশ টাকায় একশো, কুড়ি টাকায় দুশো। একটা তেলও আছে। দাঁতে ব্যথা হলে লাগাবেন। অন্তত একমাস ভালো থাকার জন্যে দিদিভাইরা একটা প্যাকেট নিয়ে যান। বুড়ো থেকে বাচ্চা যাকে খুশি মাজতে দিন। ভালো না থাকলে পয়সা ফেরৎ।” আমি ওনাকে আগে কখনো দেখিনি। সেদিনই প্রথম দেখলাম, তাই ভালো করে নিরীক্ষণ করলাম। দেখলাম তাঁর দাঁতে এতোটুকু সাদা অংশ নেই। নিকোটিনের লাল-কালো মিলে পুরো ছাপা ছাপা দাঁত।
অনেকদিন আগে বনফুল হীরালালের গল্প লিখেছিলেন। হীরালাল ট্রেনে দাঁতের মাজন বেচত। নিজের দাঁত ছিলনা, তাই ঝকঝকে বাঁধানো দাঁত পরে থাকত। আজ আর মাজনের মাহাত্ম্য প্রচার করে বিক্রি করার জন্যে নিজের দাঁত ঝকঝকে দেখানোর প্রয়োজন হয়না। আমরা সবাই জানি সব বিজ্ঞাপন নকল।
এদিকে দিদিমণি আর সেই মহিলা আলোচনা করছেন, “খুব ইগোয় লেগেছে। যিনি কাজটা করলেন তিনি কিন্তু চুপ করে আছেন, কিচ্ছু বলছেন না। উনি তো বুঝেছেন, উনি কি করেছেন।”
-- “আপনি কিছু বলুন আপনাকে পড়ানো নিয়ে অমন বলছে।”
-- “ধুর! কি বলবো, এসব গা সওয়া হয়ে গেছে, এক কান দিয়ে ঢোকাই আর এক কান দিয়ে বের করে দি। ওর কালচার কি বুঝতে পারছেন না?”
সেই মহিলা -- “সকালবেলা মেজাজটা পুরো খারাপ করে দিলো! কালচার শেখাতে এসেছে।”
অন্যরা সমর্থন করলেন -- “হ্যাঁ সকাল সকাল কি সুন্দর চান-টান করে ঠাকুরের নাম করে মানুষ বেরোয়, এরকম হলে তো খারাপ লাগবেই।”
আমার সিটের পিছনে এক মাসি দাঁড়িয়ে ছিলো, সে মোসাম্বি, কমলা বিক্রি করে দেখি আজকাল। তার হাতটা আমার মাথায় লাগায়, আমি ঘুরে তাকাতেই সে বললো, “ওই মহিলার মাথায় মনে হয় তার কাটা আছে, তাই চেঁচিয়েই যাচ্ছে। মুসলিমরা কি করলো? মুসলিমরা বুঝি পিছনে বাঁশ দিয়েছে? ওই জন্যেই তো মরে মার খেয়ে।”
এবার নামার সময় হলো। আমি গুটি গুটি করে উঠে এসে সেই মাঝবয়সী মহিলার পিছনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি তখনো থেমে যাননি। নেমে যাচ্ছেন বলে শেষবারের মতো আবার জোরে জোরে শুরু করলেন।
“সরকার টিচারদের মাইনেটা বাড়িয়ে দিয়েছে না, তাতেই রসটা হয়েছে। কাজ বলে তো কিছু নেই। যায়, গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা, মাসে মাসে মোটা মাইনেটা পাচ্ছে বলেই এতো তেজ। কি পড়ায় সে তো জানাই আছে, এক সিলেবাস বছরের পর বছর এক জিনিস, আর ওই তো সব ছাত্র। তুই যেমন টিচার আমিও তেমনি অফিসে চাকরি করি। আমাদের অমন একঘেয়ে কাজ নয়। রোজ নতুন নতুন লোক নিয়ে ডিল করতে হয়। অনেক কালচার জানতে হয়। তোদের মতো নয়।”
সহকর্মী বন্ধুকে বললেন, “তাই না বলো? আমাদের পৌরসভার অফিসে কত নতুন নতুন লোকদের নিয়ে কাজ। কত কি জানতে হয়।” বলতে বলতে লাইনের ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন।
আমি একটু এগিয়ে গেলাম। ট্রেনটাও যেন ওনার ঝগড়া শোনার জন্যে প্ল্যাটফর্ম ছেড়েই, একটু গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি লাইন পেরোতে পারলাম না।
Comments
Post a Comment