পাহাড়

ছোটবেলায় শুনতাম, জল দিয়ে আঁক কাটতে নেই, দেনা হবে। চৌকাঠে বসতে নেই, বালিশে বসতে নেই। কারণগুলো সবাই জানে। বাবা মাঝে মাঝে সত্যিটা বুঝিয়ে দিতো, বুঝতাম। কিন্তু অনেক কুসংস্কারকে পাত্তা না দিলেও একটাকে খুব দিতাম। নিজের ইচ্ছে করতো বলে। বড়মা বলতো, “পা ছড়িয়ে বসে ভাত খেলে অনেকদূরে বিয়ে হয়। বাসে করে অনেকদূর যেতে হবে, বুঝবি কেমন কষ্ট হয়।”


“ঘনঘন আসতে পারবি না, আমরাও তোর বাড়ি যেতে পারবো না, দেখবি খুব কষ্ট পাবি।” আমি তো বাসে করে দূরেই যেতে ভালোবাসি, তাই রোজ পা ছড়িয়ে ভাত খেতাম। অনেকেই বকতো। কিন্তু আমি ওই দূরে যাবার লোভে কোনোদিন পা ছড়িয়ে বসে খেতে ভুলতাম না।

ক্লাস এইট পরীক্ষা দিয়ে একটু দূরে ঘুরতে যাওয়া। তাও খুব দূর নয়। রাতে বাস ছেড়ে ভোরে পৌঁছনো। অযোধ্যা পাহাড়। প্রথম পাহাড় দেখে মুগ্ধ হওয়া। চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা এমন একটা ফাঁকা মাঠে গিয়ে বাস থামলো। ওখানেই দুপুরের খাওয়ার জন্যে রান্না, মাটিতে বসে লাইন দিয়ে খাওয়া। সকালে টিফিন খাওয়ার পর আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে জায়গাটা দেখা শুরু করেছিলাম। একটা পাহাড় থেকে ঝর্ণা। সেই ঝর্ণার জলের উৎস খুঁজতে পাহাড়ের বহুদূর অব্দি উঠেছিলাম। কিন্তু উৎস খুঁজে পাইনি। জানি পাওয়া যায় না। জুতোয় হিল ছিলো, সেটা পরে পাহাড়ে ওঠা যায় না। মাঝে পথে জুতো ফেলে রেখেই উঠে গিয়েছিলাম।

ওখানকার কিছু লোক, বউ, সব পাহাড়ের কোলে জমা জল থেকে মাছ ধরছিলো। মাছগুলো চিনতাম না, জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কি মাছ?” ওরা নাম বলেছিলো, এখন আর আমার মনে নেই। তাদের কথার টানটা বুঝতেও অসুবিধা হয়েছিলো।

ভাত খাওয়ার পর সবাই জিপে করে অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে উঠেছিলো, আমি আর যাইনি। সবাই এসে জায়গাটার সৌন্দর্য নিয়ে যে বর্ণনা দিয়েছিলো, তাতে খুব আফসোস হয়েছিলো। কিন্তু সেদিন আমার শরীরটা ভালো ছিলো না। ফলে ওটা এখনো স্বপ্ন রয়ে গেছে।

পাহাড় আমাকে উদাসীন করে, পাহাড় আমার মন ভালো করে, পাহাড়ের নির্জনতায় আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারি। পাহাড়ের প্রতিধ্বনি আমার গলাকে ফিরিয়ে দেয়, তাই সেই আনন্দে চেঁচাতেও দ্বিধা করি না।



এরপর এক এক করে হিমালয় থেকে আল্পস সব দেখার সুযোগ হয়েছে। এখনো আমার বেড়ানোর জন্যে সবচেয়ে পছন্দের জায়গা পাহাড়। অনেক পাহাড়ি জায়গা বেড়িয়েছি। তবে এভারেস্ট জয় করতে পারিনি এখনো। পারবোও না।  


এখন সত্যিই বাড়ি থেকে দূরে থাকি। রোজ রোজ চাইলে যেতে পারি না। সেটা দূরত্বের জন্যে নয়। সবাইকে দেখতে না পাওয়ার কষ্টও আছে। তবুও সবকিছুকে ছাপিয়ে পাহাড়েও মন ভালো করতে ছুটি না।

পাহাড়ের ঘন কালো গাম্ভীর্য  আর  কাঠিন্য নিয়ে অতো মাথা ঘামাই না। অভিমান, রাগ, দুঃখ, কষ্ট জমতে জমতে নিজের মনের মধ্যেই এখন একটা আস্ত পাহাড় তৈরি হয়ে গেছে।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত