লাইনে থাকুন - ১
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট্ট কাউন্টার। ডানদিকে বাঁদিকে দুটো হল। রুগিদের বসার জায়গা। তারও ভিতরের ঘরগুলোতে ডাক্তারবাবুদের বসার ঘর। আগে থেকে বা ফোন করে নাম লেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। কাউন্টারে দুজন মহিলা থাকেন। তাঁদের কাছে যে যার ডাক্তারের স্লিপে নাম লিখিয়ে জানা যায় কত নম্বরে নাম।
-- “কোন ডাক্তার দেখাবেন?”
নাম বললাম।
-- “দাঁড়ান। ছয় নম্বর পাবেন।”
পেনটা তখন ফাঁকা ছিলো না। অন্য এক মহিলা অন্য এক ডাক্তারের স্লিপে নাম লিখছিলেন। আমি মাঝে মাঝেই হাত বাড়িয়ে আমার ডাক্তারের স্লিপটা নিতে যাচ্ছিলাম।
-- “বললাম না দাঁড়াও। আরে তুমি তো আমাদের চেনা। এখানে প্রায়ই আসো তো?”
-- “হুম! ছেলের বয়েস যতদিন ততদিনই আসছি। পাঁচবছর টানা।”
-- “আরে না না, ছেলের ছোট থেকে না, তুমি ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে এখানে কোনো ডাক্তার দেখাতে আসতে না?”
-- “না, আমি এখানে বড় হয়নি।”
-- “ও, তুমি বাইরে বড় হয়েছো, বাইরে তাই না?”
-- “হুম।”
আমার চোখ তখন ডাক্তারবাবুর স্লিপে কত নম্বর সেই দিকেই। দেখলাম। নাম ছয় নম্বরে হবে। তারপর আবার কাগজ টানতে গেলাম, মনে মনে ভাবতে থাকলাম, এতো কথা বলছে কেন! আমার সঙ্গে তো এতো কথা কোনোদিন বলেনি। হয়তো এবার সত্যিই খুব চেনা হয়ে গেছি তাই।
তিনি আবার বললেন, “বলছি না দাঁড়াও।”
বলেই, তিনি কাউন্টারের ভিতরের তাঁর সঙ্গীকে বলতে লাগলেন আরে এ আমাদের চেনা। বলেই, চার নম্বর লেখা, আলাদা করে কেটে রাখা, ডাক্তারবাবুর একটা স্লিপ বের করে দিলেন। দিয়ে বললেন, “ছেলের নামটা লেখো।”
আমি নাম লিখছি, তখন উনি আমার ডান হাতের কনুইটা দেখিয়ে বললেন, “ওটা কি? তিল?”
প্রথমে বুঝতে পারিনি। আবার জানতে চাইলেন, “ওটা কি তিল?”
বললাম, “হুম। তবে সাইজে একটু বড় বলে মশা ভেবে অনেকে আমাকে অনেকবার মেরেছে।”
উনি শুরু করলেন -- “খুব সুখী হবে। দেখো বলে রাখলাম, ভীষণ সুখী হবে।”
মনে মনে ভাবলাম -- তাই নিয়ে চিন্তা করি না। আমি এমনিতেই ভীষণ সুখী।
স্লিপে ডেটের জায়গায় ডেট লিখতে গেলাম। আবার ধমক দিলেন। “বলছি না, ওসবের দরকার নেই, শুধু ছেলের নাম লেখো ব্যাস!” বলেই বললেন, “দেখলে তো ছয় হতো, চার করে দিলাম।”
ভিতরের সঙ্গী শুরু করলেন, “নববর্ষে মিষ্টি খাইয়ো। নতুন বছর পড়েছে, আমরা মিষ্টি খেতে চাইছি, তুমি খাইয়ো।”
যাঁর কাছে নাম লেখাচ্ছিলাম তিনি বললেন, “তুমি টাকা দিও, আমরা কিনে খাবো।”
আমি হাসতে হাসতে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। বর আগেই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলো।
গিয়ে ফিসফিস করে আলোচনা করলাম, “দেখলে ছয়কে চার করলো!”
-- “কি করে?”
-- “পাশ থেকে চার লেখা একটা কেটে রাখা স্লিপ আমাকে দিলো। এই দেখো। যাক গে, প্রথমবার চাইলো, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেবো।”
আমার বর বাচ্চা কাউন্ট করতে লাগলো। কাউন্ট করে বললো -- “কিচ্ছু এমন সুবিধে দেয়নি চারজনই তো আছে।
তাহলে এমন ভান করলো কেন? টাকা চাইবে বলে?”
কে জানে?
একটু পরে ডাক্তারবাবু এলেন। তখন হুড়মুড় করে সমস্ত রিপ্রেজেন্টটেটিভের দল ঢুকতে থাকলো। আর এক নম্বর বাচ্চার মাকে অন্য এক বাচ্চার মা খুব অনুনয় করে বলতে লাগলেন, “আমাকে একটু আগে যেতে দেবেন? আমার মেয়ে প্রচণ্ড কাশছে, একেবারেই বসতে পারছে না।” তিনি পত্রপাঠ বিদায়ের মতোই, শোনা মাত্রই বললেন, “না না হবে না, আমার ছেলে খুবই ছোট, ছ-মাসের, ওরও জ্বর হয়েছে।” ইনি হতাশ হয়ে চুপ করে বসে গেলেন।
আমি ভাবলাম, একের জায়গায় দুই বা তিনে নাম, ওটুকুর জন্যে ওনাদের কি আর তফাৎ হবে! তারপর এক নম্বর বেরোতে তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের এক ছিলো?” তাঁরা হ্যাঁ বলে বেরিয়ে গেলেন। দুই নম্বররা ঢুকলেন। যাঁরা তিন তাঁরা এগিয়ে দাঁড়ালেন। তখন বুঝলাম আমাদের গুনতে কিছু ভুল হয়েছিলো। ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের নাম কতোয়? তিনি বললেন, “পাঁচ।” আমার চোখ কপালে। আমার বর ইশারা করে বললো রিয়াক্ট না করতে। “এখন চুপ থাকো। ডাক্তারবাবুকে বলবো। তারমানে ওরা এটা করেই থাকে।”
আমরা দুজনে ঠিক করলাম ওনাকে আমরা আগে ছেড়ে দেবো, কারণ হিসেব মতো ওদের নাম চারে হয়, আমরা পাঁচ। ওরা আমাদের আগে এসেছে। বলে দিলাম, “আপনারা আগে যাবেন।” তাঁরা খুশি হয়ে তখনই ধন্যবাদ জানালেন।
এর মধ্যেই আরো একটি পরিবার তাঁদের বাচ্চা নিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, "ছয় নম্বর কারা?"
বুঝলাম, ছয় লুকোনো রয়েছে ঐ কাউন্টারের পেপারওয়েটের তলায়।
এর মধ্যেই আরো একটি পরিবার তাঁদের বাচ্চা নিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, "ছয় নম্বর কারা?"
বুঝলাম, ছয় লুকোনো রয়েছে ঐ কাউন্টারের পেপারওয়েটের তলায়।
আমরা তারপর গেলাম। দেখানোর শেষে ডাক্তারবাবুকে এই ঘটনা বললাম। উনি বললেন, “আমি জানি তো, ওরা এটা করে। তাও তো আমার রুগিদের থেকে কম করে, অন্যদের রুগির থেকে একশো-দুশো করে টাকা নেয়।” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমরা পাঁচ বছর আসছি, এই প্রথম হলো।” ডাক্তারবাবু বারবার বললেন, “টাকা কিন্তু দিও না।” বললাম, “না দেবো না। আলাদা করে চাইলে দিতাম, এটা করলো বলেই দেবো না।” ডাক্তারবাবু বললেন, “হ্যাঁ সেটাই। সেটা আলাদা বিষয়।”
বেরিয়ে এলাম। সেই ভিতরে বসে থাকা মহিলা আমাকে চলে যেতে দেখে ছুটে এসে টাকা চাইতে লাগলেন। প্রথমে উত্তর দিইনি দেখে, চেঁচিয়ে বললেন, “ও দিদি চাইলাম, দিলে না?”
আমি নিচের সিঁড়ি থেকে ওপর দিকে তাকিয়ে বললাম, “না দেবো না।”
-- “কেন?”
-- “চালাকি করলেন কেন?”
-- “কি চালাকি?”
-- “ওই যে, স্লিপ আগে থেকে কেটে সরিয়ে রাখা!”
প্রথমে চুপ, তারপর মনে মনে গজগজ! আমার ভাগ্যেও হয়তো প্রচুর গালমন্দ অভিশাপ জুটেছে, কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছে। কখনো কাউকে মুখের উপর কিছু বলতে পারি না। অনেক অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে দেখে প্রতিবাদ করতে না পেরে ভিতরে ভিতরে অশ্বস্তিতে ভুগি, কাল তা হয়নি।
পরে আমরা আলোচনা করলাম, মাঝে মাঝেই যে দেখতাম তিন নম্বর রুগি এখনো আসেনি, পাঁচকেও দেখা যাচ্ছে না। যেখানে আগে থেকে নাম লিখিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেই সেখানে এমন হওয়া একটু অদ্ভুত। এটাই তার হিসাব। অঙ্ক মিললো এতোদিনে।
এমনই আর এক ঘটনা জানাবো। পি এইচ ডি ফর্ম জমা দেওয়ার লাইনের মূল্য কত? তার আগে আপনারা আন্দাজ করে বলতে থাকুন কত হতে পারে।
Comments
Post a Comment