রঙ যেন মোর মর্মে লাগে

ছোটবেলায় রঙ খেলার দিনটা কবে আসবে তাই নিয়ে যতটা উৎসাহ থাকতো, খেলা নিয়ে ঠিক ততটা নয়। কোনোদিনই রঙ খেলিনি। ছুটির দিন। সকালবেলা উঠে ব্রাশ করে, কিছু একটা খেয়ে, আমি আর আমার সঙ্গীরা দোতলায় দৌড়। তারপর কেউ আমাদের ডেকে ডেকেও নামাতে পারতো না। কোনো এক ফাঁকে এসে আর একবার একটু খেয়ে যাওয়া। এই লুকোচুরিটাতে বেশ আনন্দ ছিলো। মাঝের ঘরে খিল দিয়ে বসে, জানলা দিয়ে শুধু দেখা - কাদের দল রঙ খেলতে এলো, কতজনকে মাখাতে পারলো। কারা না মাখার ভয়ে চিৎকার করে দৌড় দিয়ে ঘরে খিল দিলো। চিৎকারটা শুনলে বেশি আনন্দ হতো।
রঙের হাত থেকে বাঁচার চিৎকার তাই কখনো ভয়ঙ্কর মনে হত না।
ওইদিনটায় মা, কাকিমা, জেঠিমা, বৌদিরা কারো হাত থেকেই রেহাই পেতো না। কারণ গ্রামের খোলা-মেলা ফাঁকা জায়গার মধ্যেই সব কাজ। হয়তো কেউ গোয়াল ঘরে গেছে, কেউবা দোকান বা পুকুরঘাটে বসে বাসন মাজা।
একদল কচিকাঁচা সাতসকালে উঠে বালতিতে রঙ গুলে পিচকারি নিয়ে যাকে দেখতে পেতো তার গায়েই রঙ দিয়ে দিতো। শহরের মতো চেনা-অচেনার বাছবিচার ওখানে নেই। যে যাকে দেখতে পায় ফিচিস করে রঙ ছুঁড়ে দেয়। আমাদের জানলার দিকেও পিচকারি তাক করতো, তাতে আমাদের গায়ে পৌঁছনোর আগে মাঝ পথেই রঙ নষ্ট হতো।
একটু বেলার দিকে বক্স বাজিয়ে রঙ মাখাতে আসতো বড়দের দল। তাদের রঙ রাঙিয়ে দেওয়ার জায়গায় মাকালি বানাতেই বেশি ভালো বাসতো। হাতে তেল আর পোড়া হাঁড়ির নিচের কালি ছিলো তাদের রঙের উপকরণ। আনন্দের জায়গায় তাই ভয়টাই বেশি কাজ করতো সবার মনে।
গ্রামে একটু বড় মেয়েরা দাপিয়ে রঙ খেলে বেড়াতো না তখন। এখন কি করে আমার জানা নেই। তবে বাচ্চা মেয়েরা খেলে চিরকালই। ওইসময়ে তাও একজন মেয়েই বেশ সাহসের সঙ্গে রঙ খেলতো। আমার বন্ধু মাধবী। তার গল্প আর একদিন বলবো। তবে সেই মাধবী এলেও আমি দ্বিধা করতাম। অনেক অনুনয়, বিনয় করে বেচারি হতাশ হয়ে ফিরে যেতো।
দুপুরবেলা খেতে নামতাম। বিকেলে আবার আবিরের ভয়ে ঘরে ঢুকে থাকা। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বালতিতে একটু রঙ গুলে দুহাতে মেখে নিতাম। পরেরদিন স্কুলে বন্ধুদের কাছে জোর গলায় বলার জন্যে - “এই দেখ আমিও রঙ খেলেছি।।” যদিও লাভ হতো না, মাধবী গিয়ে সব ফাঁস করে দিতো।
খুব ছোটবেলায় বিকেলে আবির নিয়ে একটু এ- বাড়ি, ও-বাড়ি যেতাম। শেখানো হতো - বড়দের পায়ে দিয়ে প্রণাম করতে হয়, মাথায় দিতে নেই। ঠাকুমা, সেজদাদু, দুই জেঠু, জেঠিমা, ছোটঠাকুমা, বড়ঠাকুমা সবার পায়ে দিয়ে প্রণাম করতাম। আর সমবয়সীরা মাথা, চোখ, মুখ ভরিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে করতে খেলা শেষ হতো। একটু বড় হয়ে আবির খেলাটুকুও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। খুব একটা হই-হুল্লোড় কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না, এখনো নেই। তবে এখন বাড়িতে শুধু তিনজনে ফুলের আবির খেলি।
বিকেলবেলা শান্তি কাকাদের পাড়ায় রাধা-কৃষ্ণের পুজো হতো, আর ছোট করে দুচারটে দোকান বসতো। চপ, পাঁপড়ভাজা, জিবেগজার দোকান। সেও সেই আবিরের ভয়ে যেতে ভয় পেতাম। কখনো সে উৎসব দেখা হয়নি।
সবাই দোল খেলো আনন্দ করো। সে আনন্দ যেন সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার মতো হয়। সাময়িক আনন্দ পেতে গিয়ে আমরা সবাই কিছু না কিছু ভুল করেই থাকি। শুধু এটুকু খেয়াল রাখা যে, একজনের আনন্দ যেন অন্যের কাছে আঘাত হয়ে ফিরে না আসে। আনন্দ আঘাত হয়ে ফিরে এলে তখন কিন্তু আর বলার জায়গা থাকে না -
“আঘাত সে যে পরশ তব
সেই তো পুরষ্কার।”
ভালো থাকো সবাই, ভালো করে আনন্দ করো। সবাই সবাইকে রাঙিয়ে দাও। সেই রঙ যেন শুধু মর্মেই লাগে। শুভ দোল উৎসব।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত