কুটুমবাড়ি

সকালে আমরা তিনজনে গিয়েছিলাম আমাদের বিরাটির বাড়ি, আমার শ্বশুরমশাই-শাশুড়িমা’র কাছে। ছেলে বহুদিন পর দাদান বৌঠানের বাড়ি গিয়ে আর কিছুতেই ফিরতে চাইলো না। আমাদের বলে দিলো তোমরা চলে যাও। অনেক বোঝালাম, আমি বাড়ি ফিরে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। মুখ ভার করে চুপ করে থাকলো। তার ইচ্ছে দুদিন সেখানে থেকে পরশু বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় তাকে নিয়ে ফিরুক। শেষে আমি বললাম, তাহলে আজ দাদান বৌঠান আমাদের বাড়ি যাক, কাল চলে আসবে। তাই শুনে মুখে একটু হাসি ফুটলো। কিন্তু শুরু হলো দরকষাকষি। দাদান বললো আজ যাই কাল সকালে উঠেই চলে আসবো। নাতির মিহি সুরে বায়না স-কা-লেএএ নয়। সন্ধ্যেবেলা তোমরা আসবে। দর কষে রফা হলো কাল দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ও যখন ঘুমোবে তখন তাঁরা যাবেন। এমন হতেই পারে যে তখন আবার ওনাদের সঙ্গে ও যেতে চাইবে।
আজ আমার মনে হলো - আমাদের পুতুলখেলার সংসারটা ঠিক এইরকম ছিলো। আমরা পুতুল সাজিয়ে কুটুমবাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে না আনতেই আবার অন্য পুতুলের বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে যেতো।
এভারেডি ব্যাটারির বাক্সে বন্দি পুতুলের সংসার। আমরা অভিভাবক। পরপর তিনটে পরিবার বাক্স সাজিয়ে গাড়িবারান্দায় শুরু হতো পুতুলখেলা। খেলার নিয়মে নতুনত্ব কিছু ছিল না, একটাই নিয়ম, সবাই সবার বাড়ি যাওয়া। একজন বাক্স খুলে পুতুলকে শাড়ি, গয়না পরিয়ে তৈরি করে নিয়ে অন্যদের জিজ্ঞেস করতো - “কি গো কাদের বাড়ি কুটুম যাবে?” যে রেডি থাকতো সে বলতো আগে আমার বাড়ি এসো। মাটির পাল্কিতে পুতুলদের নিয়ে যাওয়া হতো, সঙ্গে মুখে পালকি-বেয়ারাদের হেঁইয়ো হেঁইয়ো আওয়াজ আর পালকির গান। আমরা একটু দূরে দূরে বসতাম, যাতে পালকিটা নিয়ে বেশ একটু যাওয়া যায়। তারপর কুটুমবাড়ি পৌঁছে, অন্য পুতুলদের সংসারে খাওয়া দাওয়া আর ঘুম সেরে বাড়ি আসার সময় বলা হতো - “কাল কিন্তু তোমরা আমাদের বাড়ি যাবে।” খেলার নিয়মে একবেলাতেই কাল, পরশু, সন্ধ্যে, বিকেল সবটা একসঙ্গে হয়ে যেতো।
আমাদের সময় ছিলো মাটির পুতুল। হয় কেউ কাদামাটি দিয়ে বানিয়ে দিতো, নয় মা মামাবাড়ি থেকে ফেরার সময় চক্রপুর থেকে কিনে আনতো। তবে চক্রপুরের পুতুলগুলোর ডিজাইন আমার ভালো লাগতো না। সব কেমন ছেলে ছেলে দেখতে। মেয়ে পুতুলগুলোর মাথায় খোঁপা থাকতো না, কেমন একটা পাগড়ি থাকতো। আর রঙ কুচকুচে কালো। বিচ্ছিরি লাগতো, তবুও উপায় না থাকলে ওগুলোই ভরসা। আমাদের গ্রামের কেউ কেউ পুতুল বানিয়েও দিতো। তাদের কি সুন্দর খোঁপা থাকতো। সেই খোঁপার চারপাশে ঝাঁটার একটা কাঠি ফুটিয়ে ফুটিয়ে টিপ টিপ করে গোল করে একটা ডিজাইন করা হতো। কাঠি দিয়েই সিঁথি, আর টিপ পরানোর জন্যে কপালে একটা গোল এঁকে দেওয়া হতো। সেখানে সিঁদুর দিতাম। আর খোঁপায় ফুলের মালা না দিয়ে পুঁতির মালা, গলা, হাত সবেতেই পুঁতি দিয়ে মালা বানিয়ে পরানো হতো। পুতুল সাজানো নিয়ে আড়ম্বরটাই ছিলো আলাদা। মা-কাকিমাদের বাতিল করা সুন্দর সুন্দর সুতির ছাপা শাড়ি থেকে কিছুটা চেয়ে নিয়ে, সেগুলো আবার পুতুলের সাইজ অনুযায়ী কেটে গুছিয়ে দেশলাই বাক্সে ভরে রাখা হতো। দেশলাই বাক্স ছিলো পুতুলের কাপড়ের আলমারি। সেগুলো বিনা জলে কাচার ভান করে শুকনোও করতে দেওয়া হতো। ব্যাটারির বাক্সে কাপড় পেতে পেতে পুতুলের বিছানা তৈরি করা হতো। যার বিছানা যত উঁচু হত তার চোখ তত জ্বলজ্বল করতো।
এখন পুতুলখেলার কুটুমবাড়ি কুটুমবাড়ি খেলা যেমন উঠে গেছে, আজকালকার ব্যস্ত জীবনও তাই। পুতুলখেলা ব্যাপারটা এখনো আছে। বদলেছে পুতুলগুলো। নামটাও। কেউ পুতুল বলে না। সব বারবি ডল। বড্ড দাম। একটা ডল কিনতে খুব গায়ে লাগে।
সেই কথায় কথায় আর কুটুমবাড়ি যেতেও পারি না। এখন পাল্কি নেই, গাড়ি আছে। তবুও।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত