বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর

মাটির তিনতলা বাড়ি। তিন কামরা করে মোট ন-কামরা। রান্নাঘর, উঠোনসহ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একদিকে গুলপেরেক লাগানো খিড়কি দরজা, অন্যদিকে উত্তরের বড় দরজা। শহরের লোক শুনলেই চমকে উঠতো, সেকি? তিনতলা? মাটির? এমন হয়? বিশ্বাসই করতো না। দাদাভাই তো খুব কৌতূহলী ছিল - আমরা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে পারতাম কিনা তাই নিয়ে। বলতাম, আমরা সবাই রীতিমত দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি করে খেলতাম। এখনো বাড়ির বাচ্চারা তাই করে। শুনে সে বলেছিলো তাহলে একবার আমি তোদের বাড়ি যাবো গিয়ে বারান্দায় খুব লাফাবো। সেই পরীক্ষা সে এখনো করে উঠতে পারেনি।


তিনতলার মাথায় আগে ছিলো খড়ের ছাউনি। গরমকাল এবং শীতকাল, দুই সময়েই খুব আরামদায়ক। আমার দেখা সেটা অ্যাজবেসটস হলো। আর ঘরে আলো ঢোকার জন্যে আর একটা কি মেটেরিয়াল দিলো, নামটা জানি না তবে তা ভেদ করে আলো আসে খুব সুন্দর। দিনেরবেলাতেই টিউব লাইটের আলোর মতো দেখায়। গরম বাড়লো।


দোতলায় বরাবরি টিনের চাল ছিলো, তাই গরমকালের দুপুরে আমরা কেউ ওপরে থাকতাম না। নিচেরতলার আরাম কেউ ছাড়তে চাইতো না। তবে তিনতলায় খড় থাকার সময় দোতলার ঘাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতো না।


পুরো বারান্দা থেকে গাড়িবারান্দা সবই রেলিং দিয়ে ঘেরা। গরমকালে আমরা বারান্দায় শুতাম। প্রচণ্ড হাওয়া, ফ্যানের দরকার হতো না। শুরুতে ফ্যান ছিলোও না, পরে সবই হয়েছে। টিনের চালে ভোরবেলার শিশিরের টুপটাপ আওয়াজ উপভোগ করতে না করতেই  সু্য্যিমামা চোখ রাঙিয়ে বলতো - বিছানা ছাড়ো।


বড় জেঠুরা আর আমরা ওই বাড়িতে একসঙ্গে থাকতাম। মেজোজেঠুরা ওরকমই আর একটা বাড়িতে, সেটা আরো পুরোনো। এখন সেটা রিপেয়ার করে অনেক নতুন করে ফেলা হয়েছে। বড় জেঠুদের সঙ্গে ভাগাভাগি হওয়ার সময় কথা হলো একজনরা বাড়িটা কিনে নেবে, অন্যরা নতুন বাড়ি করে নেবে। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো জেঠুরা বাড়িটা কিনুক। তাহলে বেশ আমাদের নতুন পাকাবাড়ি হবে। তখন ওখানে যারা বাড়ি করতো সবাই পাকাবাড়িই করতে শুরু করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমার মা পাকাবাড়িতে বড় হওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই ওই বাড়ি ছাড়তে চাইলো না। বলতো, “তোর দাদারা বাইরে থাকে, বাবা নেই, আমি এই ছোট ছোট দুটো মেয়ে নিয়ে একা সব সামলাতে পারবো না। বাড়ি তৈরি করা মানে চাট্টিখানি কথা নয়।” ভেবে দেখেছিলাম সত্যিই তাই। একটা তৈরি বাড়ি আর একটা বাড়ি তৈরি করার তফাৎটা এখন আরো ভালো বুঝি।


আমাদের বাড়িটার একটা আকর্ষণ ছিলো পেঁচা। তিনতলায় খড়ের চালের কাঠামোর কাঠে পেঁচাগুলো বসে থাকতো। মনে হতো ঘুমোচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ এলেই তাকে টেনে টেনে বাড়ির পিছন দিকের খামারে নিয়ে গিয়ে পেঁচা দেখাতাম। অনেক উঁচু তাই ভালোভাবে দেখতে না পেলে সোজা তিনতলায় হাজির হয়ে যেতাম। বলতাম এগুলো আমাদের পোষা পেঁচা। এখানেই থাকে। নাম লক্ষ্মীপেঁচা।  ঠাকুমা বলতো কালপেঁচা নাকি খুব খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করতাম কালপেঁচা বলে কেন? ওরা কি খুব কালো? বলতো, না। তবে লক্ষ্মীপেঁচা সাদা। এখন লক্ষ্মী আর কালের তফাৎও বুঝি।


ঠাকুমা বলতো পেঁচাগুলো সারাদিন ওখানে থাকে রাতে খাবারের খোঁজে বেরোয়। কেন এমন করে? জানতে চাইলে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতো। পরে বিজ্ঞান বইতেও পড়েছি। একদিন তিনতলায় রাতে খুব ছটফটানি শব্দ শুনেছিলাম। পরেরদিন তিনতলায় উঠে দেখেছিলাম একটা প্যাঁচার প্রচুর পালক ওখানে ছড়িয়ে ছিলো। বুঝে গেছিলাম ঠাকুমার বিড়াল ছাড়া ওটা আর কারো কাজ হতে পারে না। কোনো পশু পাখি মারা গেলে ঠাকুমার মতো আমিও খুব কষ্ট পেতাম, মন খারাপ হতো।


আর একটা আকর্ষণ ঝাঁপ কপাট। এটা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে বিশেষ কায়দায় দরজার পাল্লা দুটো হেলানো থাকে। ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তখন সব বাড়িতেই থাকতো। ডাকাতরা কুড়াল দিয়ে দরজা ভাঙতে গেলে সেই কুড়াল তাদের মাথায় এসে যাতে পড়ে তেমনভাবেই সেই দরজাটা তৈরি।


এই জিনিসটাও বাইরে থেকে কেউ গেলে সে দেখতে চাইতো। আমরা ছোটরা তখন খোলা বন্ধ করে দেখাতে পারতাম না। বড়োরাই দেখাতো।


চোরাগলিও আছে। সেও চোর ডাকাতের উপদ্রবের জন্যেই তৈরি হতো। একটা ঘর থেকে আর একটা ঘরে লুকিয়ে যাওয়ার জন্যে ছোট্ট একটা গলি। কিন্তু গলি আমাদের ছোটদের উপদ্রব এতো বাড়িয়ে দিতো যে, বড়রা শান্তিতে বসতে পারতো না। একটাই আনন্দ - গলি দিয়ে গিয়ে লুকোচুরি খেলা। ছেলেবেলাটা এখনো ওই গলির মধ্যেই আবদ্ধ।


তিনতলা বাড়িটার গল্প ঠাকুমা বলতো। ওটা কবে তৈরি, কতটা জায়গা নিয়ে তৈরি। হিসেব ভালো লাগতো না। একটা কথা বলতে গিয়ে ঠাকুমার চোখে জল এসে যেতো, তবুও বলতো। “তোর বাবাও এই বাড়িটা তৈরির সময় দু একদিন মুনিষদের সঙ্গে মাটি তুলে দিয়েছে। মাটির দেওয়াল তোলা বাড়ির একটা পদ্ধতি আছে। বহুদিন লাগে। মাটি তৈরির একটা ব্যাপার, একদিন মাটি দেওয়ার পর আবার কতদিন পর দিতে পারবে সেসব নিয়ম আছে। ওই গল্প শুনেই হয়তো মা বলতো, “স্বামী শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবো না।” মনের ভিতর কোথাও একটা ভালোলাগা, একটা বিশ্বাস, একটা অধিকার, একটা আনন্দ হয়তো বাবার ওই দুদিন মাটি দেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে।


এখন আমাদের পাকাবাড়ি হয়েছে। জল থেকে সব সিস্টেমই শহরের মতো। আমি নিজেও পাকাবাড়িতে থাকি। অনেক শক্ত শক্ত জিনিস ইট, লোহা, কংক্রিট, সিমেন্ট সব দিয়ে তৈরি। তবুও মা এইসব বাড়ির ভিতকে মজবুত ভাবে না। আমার বাড়িতে থাকার সময় তার সব সময় মনে হতো -

“ফিরে চল্‌, ফিরে চল্‌, ফিরে চল্‌ মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।।”


দীর্ঘদিন, ঝড়-বৃষ্টি সামলে, অনেক মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে যে বাড়িটা মাথা উঁচু করে এখনো দাঁড়িয়ে। মাও সেই বাড়িতেই মাথা উঁচু করে বাঁচে। দেশের টানে, মাটির টানে সন্ধ্যে হলে ওই বাড়িতেই ফিরে যায়। তার সমস্ত ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-আহ্লাদ যা কিছু সব ওই বাড়িটাকে ঘিরে।


মা, জেঠিমারা সবাই ঘর, বাড়ি, আর ঘরকরার তফাৎ করে না। তাদের কাছে তিনটেই ঘর। মাটির দেওয়াল হলেও শক্ত ভিত। তাদের বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। তাই আর তিনটের তফাৎ নিয়ে তর্ক চলে না।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত