মার্ফির নিয়ম
মার্ফির নিয়মে বলে, “Anything that can go wrong, will go wrong”.
রিক্সাতে ওঠার পরই রিক্সাওলা চলতে শুরু করলো। একটানা পথের বন্ধুদের সাবধান করে দিতে দিতে। “এ ভাই সাবধান, সামলে।” উল্টোদিকের এক ট্রলিওলা অনেক মাল নিয়ে ফিরছিলো, তাকে বললো, “কি? মোটা ভাড়া? মোটা ভাড়া মনে হচ্ছে?”
আমার কলিগ জগবন্ধুদা রিক্সাওলাকে একটু সতর্ক করে দিয়ে খুব শান্ত গলায় বললো, “ভাই একটু টেনে দিও। সাড়ে চারটেয় ট্রেন ধরতে হবে।” জগবন্ধুদা খুব শান্তশিষ্ট, নিরীহ মানুষ।
রিক্সাওলা নিজের জ্ঞান জাহির করার একটা বিষয় পেলো। ঘুরে বলতে শুরু করলো, “হ্যাঁ রাস্তা দেখে সাবধানে যেতে হবে তো। আমরা রাস্তা দেখেই চালাই। আপনি বলেছেন আমি শুনলাম। কিন্তু সাবধানেই যাবো।”
জগবন্ধুদা -- “হ্যাঁ, সাবধানেই যাবে, বলছি একটু টেনে দিও। আমি কতদূর যাবো জানো তো? আমার অনেক দূরে বাড়ি। সেই বনগাঁ লাইন।”
রিক্সাওলা -- “ও বনগাঁ? সেই সেই সেই উত্তরে তো?”
জগবন্ধুদা -- “হ্যাঁ উত্তরে, সেই বর্ডার লাইন। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরতে হবে, এটা মিস করলে…”
--- “সেই উত্তরে তো?”
--- “হ্যাঁ, আমার যেতে তিনঘণ্টা লাগবে।”
রিক্সাওলা অনেক হিসেব কষে বললো, “তোমার তো বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে গো! সেই রাত দুটো বেজে যাবে।”
আমি চুপ না থেকে জগবন্ধুদাকে বললাম, “ঘাঁটালে কেন? বুঝতে পারছো তো ও কি? অনেক হিসেব কষে বলে দিলো তুমি রাত দুটোয় পৌঁছবে।”
জগবন্ধুদা হাসলো।
একজন টাকমাথা, চশমাপরা, মাঝবয়েসী ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। রিক্সাওলা প্রচন্ড চিৎকার করে উঠলো, “ও দাদা, ও দাদা…”।
দাদা শুনতে পাননি।
আবার চিৎকার..
রিক্সা যখন দাদার কাছাকাছি চলে এলো, তখন বললো, “কেমন আছেন দাদা?”
দাদা একগাল হেসে বললেন, “ভালো।”
দাদাকে চিনতে পারার গর্বে রিক্সাওলা বললো, “আমি পিছন থেকে দেখেই বুঝেছি, দাদা। আমি ঠিক বুঝেছি।”
তারপর যেতে যেতে রাস্তার ছেলেদের -- “এ বাবু সাবধানে। এ ভাই সাবধানে। দেখে চল। অটো আসছে পিছনে।”
আবার চিৎকার এক ট্রলিওলার উদ্দেশ্যে। “এ ভাই সামনে চলো। সামনে দেখ, পিছে মাত দেখ।”
তার কাছাকাছি গিয়ে, “গাড়ি চালানেকে ওয়াকথ সামনে দেখ ভাই, পিছে মাত দেখনা।”
জগবন্ধুদা অস্থির হয়ে আবার বলে উঠলো, “একটু সামনে টেনে দিও ভাই। ওই স্টেশন।”
-- “কোনদিকে এই দিকে? না ওই দিকে?”
-- “এইদিকে সোজা।”
ওটুকু রাস্তা যেতে যেতেই সবাইকে সাবধান বাণী, “এই বাবু, দেখে, এই ভাই দেখে।”
ভাবছিলাম, কি জানি এ আজ এতো কায়দা করছে, আমরা ট্রেনটা পেলে হয়।
আমরা স্টেশনের কাছাকাছি এসেছি, নেমে পয়সা দেওয়ার আগে সে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া লোকদের প্রতি চিৎকার করতে লাগলো -- “ও দাদা যাবে নাকি? আমি যাবো তো, ফিরবো তো, এই তো নামিয়ে দিয়েই যাবো।”
আমরা টাকা দিয়ে নেমে গেলাম।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দুজনেই নিশ্চিন্ত হলাম। মনে হলো, যাক বাবা ঠিক সময়ে পৌঁছে দিয়েছে, আমরা ট্রেনটা পেয়ে যাবো।
আমরা কথা বলছিলাম, হঠাৎ মনে হলো একটা পোকা আমার গলায় ঢুকেছে। আমি তো নাকে কেঁদে বলতে শুরু করলাম, “এ বাবা একটা পোকা মনে হয় আমার গলায় ঢুকেছে…”
ততক্ষণে ট্রেন ঢুকে গেছে। প্রচণ্ড হুলুস্থুল কান্ড। খুব চেঁচামেচি। অথচ দেখছি কোনো প্যাসেঞ্জারই ট্রেনে উঠতে পারছে না।
পোকার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ট্রেনে ওঠায় মন দিলাম। দেখি একটা লোক সাইকেল নিয়ে কামরা থেকে নামার চেষ্টা করছে, নামতে পারছে না। যদিওবা নামলো, তার লুঙ্গি গেলো সাইকেলের হ্যান্ডেলে আটকে। ট্রেনে ওঠার মুখ পুরো গার্ড হয়ে গেলো। এদিকে ট্রেন হর্ন দিয়ে দিয়েছে। ভাবলাম ফাঁকা হয়ে যাবে, উঠতে পারবো। মুহুর্তেই দেখি ট্রেনের গতির সঙ্গে জগবন্ধুদা তাল মিলিয়ে দৌড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আমি গতি দেখে আর চেষ্টা না করে ভয়ে “জগাদা ছেড়ে দাও, জগাদা ছেড়ে দাও করে চিৎকার শুরু করলাম।”
জগবন্ধুদাকে জগাদা বলা সে একেবারে পছন্দ করে না। কিন্তু তখন আমি ভয়ে পুরো নাম উচ্চারণ করার কথা ভাবিওনি। তার মধ্যেই একজন বয়স্ক লোক ট্রেনে উঠতে গিয়ে আমার পাশে পড়ে গেছেন। সবাই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি দেখছি প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়ে যাবে, তবুও জগাদা উঠতে পারেনি। অনেক চেষ্টায় সে ওঠার পর আমি শ্বাস নিলাম। এদিকে দেখি সেই বয়স্ক লোককে তুলে সবাই ধুলো ঝাড়াঝাড়ি করছে, লেগেছে কিনা জানতে চাইছে। ওনার খুব বেশি লাগেনি বুঝে নিয়ে আমি গুটিগুটি পায়ে স্টেশনের পিছনের দিকে এলাম। পরের ট্রেনের অপেক্ষা।
অগত্যা মহিলা কামরা।
এক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখছিলাম। ট্রেন এলো। আমি সিট পেয়ে বসে লিখতেই থাকলাম। পরের স্টেশনে একটা মেয়ে প্রচণ্ড দৌড়ে এসে আমার পাশে বসে খুব হাঁপাতে লাগলো। তারপর সে ওই হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ট্রেন মিস না করার কাহিনী বলেই চললো।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো তুমুল ঝগড়া। গেটের কাছে দুই মহিলা। তাদের থামাতে আরো অনেক মহিলা চেঁচিয়ে সহযোগিতা করলো। আমার কানে এলো, “তোমরা মনে করো সব তোমাদের না? কলকাতা তোমাদের, টালিগঞ্জ তোমাদের, বিহার, গুজরাট, বজবজ সব তোমাদের? সবাই পেটের জ্বালায় বেরোয়। সবাইকে নামতে দাও আগে। তোমারা এতো বোঁচকা নিয়ে গেটে জ্যাম করে থাকবে, আবার উলটে ঝগড়া করবে? ভেবেছো কেউ কিচ্ছু বলবে না, না?” তারপর আবার তিনিই দেখলাম শান্ত গলায় বোঝাচ্ছেন কিভাবে ঝগড়া না করে নামা ওঠার জন্যে সবাইকে সহযোগিতা করতে হয়।
নেমে এলাম। বাড়ি ফিরে পোকাটার কথা মাথায় এলো। বমি করে বের করার অনেক চেষ্টা করলাম। দেবপ্রিয় বললো, মিছিমিছি তিনদিনের খাবার পেট থেকে না বের করে পোকাটা জল দিয়ে খেয়ে নাও।
আমি ভয়ে জল খাইনি।
এখন গলা ভেঙে গেছে। সেটা জগাদা জগাদা বলে চেঁচিয়ে নাকি পোকা বের করতে গিয়ে জানিনা।
এখন শুনলাম মার্ফির নিয়ম বলে নাকি একটা কথা প্রচলিত আছে।
“Anything that can go wrong will go wrong.”
Comments
Post a Comment