গেস্ট হাউস
তিনদিন ত্রিপুরা ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউসে ছিলাম। সকালবেলা দুজন মাসি ঘর পরিষ্কার করে মুছে দিতো। মাসিরা ঘর ঝাঁট দিতে দিতে রুহানকে দেখে বললো, “ছেলে বাচ্চা আছে না ম্যাডাম?”
প্রথমে বুঝতে না পেরে বললাম, “কি?”
মাসি আবার বললো, “ছেলে বাচ্চা?”
বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ ছেলে।”
মাসি বললো, “ও বাংলা বোঝে?”
বললাম, “হ্যাঁ বোঝে বলতে পারে, পড়তে, লিখতে সব পারে।”
-- “আপনিও তো বাংলা বলতে পারেন ম্যাডাম। এখানে অনেক ম্যাডাম আসেন কিন্তু বেশিরভাগই বাংলা বলতে পারে না। আমাদের খুব কষ্ট হয়। কেউ বাংলা বলতে পারলে আমরা কথা বলতে পারি। কথা বললে একটু ভালো লাগে।”
-- “আপনারা তো কলকাতা থেকে এসেছেন ম্যাডাম? আপনাদের দেখলেই বোঝা যায়। আমরা গ্রামে থাকি ম্যাডাম, আমাদের কথা কলকাতার মতো বালো বাংলা না, শুদ্ধ বাংলা না। আপনি আমাদের কথা বুঝতে পারছেন?”
-- “হ্যাঁ পারছি।”
-- “আমাদের অনেক কষ্ট ম্যাডাম। আমরা সকালবেলা বাড়ি থেকে দৌড়তে আসি, অনেক কাজ করি এখানে তেমন মাইনে পাই না।”
-- “কতদূর থেকে আসো?”
-- “আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে।”
-- “হেঁটে আসো কেন? অটো, টোটো বা বাস নেই?”
-- “থাকবে না কেন ম্যাডাম? আমরা গাড়িতে খরচা করে ফেললে আর কি থাকবে? দেড়শো টাকা কম ছহাজার টাকা মাইনে।”
-- “খাবার দাবার? তোমরা যে কাল সিঁড়ির নিচে বসে ভাত খাচ্ছিলে ওটা কি…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে -- “ওটা তো আমরা বাড়ি থেকে এনেছি ম্যাডাম।”
-- “রান্না কখন করলে?”
-- “আমরা অনেক ছকাল উঠে রান্না করে, তারপর তাড়াহুড়া করে বের হই ম্যাডাম। এরা কিচ্ছু খেতে দেয় না। আমরা মাসে মাসে মাইনেও পাই না। এই তো আজ মাসের তেরো তারিখ হয়ে গেলো এখনো আগের মাসের টাকা পাইনি।”
-- “তোমাদের মাইনে মাসে মাসে ফিক্সড না?”
-- “না ম্যাডাম। আমরা ছেন্টাল নই। আমরা কন্টাক্ট। ছেন্টাল হলে মাসে মাসে মাইনে পায়। আমরা কন্টাক্ট তো তাই আবার বদলি হয়ে যেতে পারি। আবার অন্য জায়গায়।”
-- “তোমাদের বাড়িতে কে কে আছে? তোমাদের আয়েই চলে?”
একজন মাসি বললো -- “আমার বর নেই দুই ছেলে। এক ছেলে বি এ পাশ করেছে আর এক ছেলে কলেজে উঠেছে।”
আর এক মাসি বললো -- “আমার বর ভালো কাজ করতে পারে না। এক ছেলে সে বিয়ে করেছে। তার একটা ছেলে আছে আপনার ওই বাবু ছেলেরমতো। ছেলেও বেশি আয় করে না। কাঠের মিস্ত্রী।”
-- “আপনার বাবু ছেলে খুব ঠাণ্ডা ম্যাডাম। আমাদের বাবু খুব দুষ্ট।”
-- “তোমার নাম কি বাবু?”
বাবু খুব নিচু গলায় বললো -- “রুহান।”
মাসি আবার আমার সঙ্গে কথা শুরু করলো।
-- “এখানে আমরা পাম্মানেন্ট হয়ে গেলে আমাদের একটু উপকার হয় ম্যাডাম।”
-- “কারা পার্মানেন্ট এখানে? সিকিওরিটিরা?”
-- “না ম্যাডাম। ওরাও না। ওই রান্নার ওরা। যাদের কুক বলে তারা। ওরা বারো হাজার করে মাইনে পায় ম্যাডাম। আমরা ওরকম পেলেও আমাদের বালো হয়।”
-- “আপনি কিছু কত্তে পারেন না ম্যাডাম? দ্যাখেন না যদি কত্তে পারেন আমাদের খুব উপকার হয় ম্যাডাম।”
থতমত খেয়ে বললাম, “আমি কি করে পারবো? আমি তো এখানকার কেউ নই। আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আমি তো ঘুরতে এসেছি মাত্র। আমিও এখানে পয়সা দিয়ে থাকছি খাচ্ছি।”
-- “আপনি কিছু পারবেন না, না ম্যাডাম?”
-- “না গো পারবো না।”
-- “কথা বলে ভালো লাগলো ম্যাডাম। কদিন আছেন?”
-- “আর একদিন।”
-- “ঠিক আছে তাহলে কাল দেখা হবে। আমাদের অনেক কাজ। চোদ্দটা ঘর, সব বারান্দা, রান্নাঘর, হল, ঝাঁট দিয়ে মোছা। সবজি কাটা, মাসন মাজা সব বাকি ম্যাডাম। শরীর দেয় না, পেসারটা লো হয়ে গেছে ম্যাডাম।”
পরেরদিন আবার হাসি হাসি মুখ করে -- “বালো আছেন ম্যাডাম?”
-- “হ্যাঁ ভালো আছি।”
-- “কাল চলে যাবেন ম্যাডাম?”
-- “হ্যাঁ, কাল সকালে।”
-- “আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব বালো লাগলো ম্যাডাম। ওই দুশো এক নম্বরেও এক ম্যাডাম এসেছিলেন একবার। খুব বালো। আমাদের সঙ্গে কথা বলতো। সেই ম্যাডাম যাওয়ার সময় একশো টাকা দিয়ে গেছিলো। আপনার হাতে যেমন রিং আছে…”
আমি বুঝতে পারছিলাম না বলে আমার আঙুলের দিকে দেখিয়ে বললো, “ওই যেমন আংটি আছে ওই ম্যাডামেরও আঙুলে আংটি ছিলো।”
আমি তার গল্প কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে আগেই ধরে নিয়েছিলাম, সেই ম্যাডাম বুঝি আংটিটা খুলে ওই মাসিকে দিয়ে গেছে।
আমার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে মাসি বললো, “আংটিটা ম্যাডাম ফেলে গেছিলো, আমি আবার কুড়িয়ে জমা দিয়ে দিয়েছি। খুব বালো ম্যাডাম ছিলো। আমাকে একশো টাকা দিয়েছিলো।”
কথা বলতে বলতেই মাসি আমার মোবাইলে কড়ুইয়ের ছবিটা দেখে বললো -- “এটা কি ম্যাডাম?”
-- “তুমি বলো এটা কি?”
-- “দানের গুলা তো ম্যাডাম?”
-- “হুম ধানের গোলা।”
-- “আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামে যাবেন ম্যাডাম? আপনার খুব বালো লাগবে। কত কি আছে। আপনার দেখে খুব বালো লাগবে। আপনি অনেককিছু লিখতে পারবেন। ইউনিভার্ছিটি থেকে তো অনেকে যায় ম্যাডাম। কত কি লিখে আনে।”
-- “ঠিক আছে আবার যদি কখনো আসি যাবো।”
-- “আমরা যদি এখানে না থাকি ম্যাডাম? আপনি আমাদের মনে রাখবেন? বুলে যাবেন তো ম্যাডাম। আমরা তো কন্টাক্ট এ কাজ করি ম্যাডাম।”
-- “ভুলবো না। আমি তোমাদের ছবি তুলে রাখছি।”
-- “হ্যাঁ ম্যাডাম। এখানে দেখালে এরা বলে দিতে পারবে। আমরা কোথায় কাজ করি। আমাদের নাম লিখে রাখুন ম্যাডাম।”
-- “ঠিক আছে নাম বলো। লিখছি।”
তারা নাম, গ্রামের নাম, পোস্ট অফিস সবই বললো।
জিজ্ঞেস করলাম, “লেখাপড়া জানো?”
-- “একটু একটু জানি ম্যাডাম।”
একজন মাসি বললো, “আমার খুড়াতো বোন আছে একটা আপনার মতো চুল তার। ওরকম পাকানো পাকানো। আপনার মতো গায়ের বন্ন, পরিষ্কার রঙ। এখনো বিয়ে হয়নি। আপনার মতোই দেখতে।”
-- “সকালে তোমরা কি খেয়ে এসেছো মাসি?” একজন বললো, “শুধু চা আর একজন মুড়ি আর চা।”
আমার কাছে গেস্ট হাউসের ব্রেকফাস্টে পাওয়া কলাগুলো ছিলো, দুজনকে দিয়ে বললাম খেয়ে নাও।
খুব খুশি হয়ে নিলো। খেয়েছিলো কিনা আর জানতে চাইনি।
দুই মাসির নাম রেখা আর জয়ন্তী।
রেখা মাসি তার দুঃখের আরো অনেক গল্প শুনিয়েছে। রেখা মাসিই বেশিরভাগ গল্প বসে বসে করেছে। সে জয়ন্তী মাসিকে দিয়ে একটু কাজ করিয়ে নিতে ভালোবাসে দেখলাম। জয়ন্তীমাসি খুব নিরীহ, শান্ত, হাসি হাসি মুখে সারাক্ষণ কাজ করছে।
কাজ শেষ করে তারা সিঁড়ির নিচে বসে ভাত খায়। শুয়ে থাকে। চুল আঁচড়ায়, ওখানে তাদের জন্যে একটা ড্রেসিংটেবিল আছে। পা মেলে বসে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কুঁচিয়ে পান সাজে। কাজ শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরে যায়।
আজ আসার সময় আমিও একশো টাকাই দিয়ে এসেছি। রেখা মাসি জানতে চাইলো, আমি রাগ করেছি কিনা?
-- “রাগ করবো কেনো?”
-- “না ম্যাডাম আমরা অনেক গল্প করেছি, আমাদের অনেক দুঃখের কথা বলেছি।”
-- “না না মাসি। রাগ করিনি। রাগ করবো কেন?”
-- “আবার আসবেন ম্যাডাম।”
-- “হ্যাঁ আসবো।”
সরল মানুষগুলোর কাছ থেকে বিদায় নিতে খুবই খারাপ লাগছিলো। খারাপ লাগছিলো তাদের অসহায় আকুতির কথা ভেবে। কিন্তু আমি আরো বেশি অসহায়। তাদের সহায়তা দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার একেবারেই যে নেই, সেটা মাসিরা বুঝলো কিনা জানি না।
Comments
Post a Comment