কড়ুই
শীতের ঠিক আগে আগে মুর্শিদাবাদ থেকে মিস্ত্রী আনা হতো কড়ুই তৈরি করার জন্য। তারা এসে অনেকদিন থাকতো, খেতো, আর কড়ুই বুনতো। এই কাজটা সবাই পারে না। একটা কড়ুই বুনতে অনেকদিন সময় লাগতো। আমি ছোটবেলায় দুটো কড়ুই বোনা দেখেছি। মড়াই বোনাও দেখেছি একবার।
মড়াইটা খড় পাকিয়ে বিচালি তৈরি করে বুনতে হতো, আর কড়ুইটা বাঁশের বাতা দিয়ে। মড়াই নিয়মমতো ছোট-বড় করা যেতো। কড়ুই একবার তৈরি হয়ে গেলে ফিক্সড। ষাট মণ, আশি মণ, নানা মাপের কড়ুই হতো।
প্রথমে মাটিতে বাতা পুঁতে পুঁতে গোল করে পানের ডাবরের মতো একটা ফ্রেম বানানো হতো। তারপর তারমধ্যে আরো সরু সরু বাতা দিয়ে দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করে কড়ুই বোনা হতো। ঝুরি, চুপড়ি, ধামা বানানোর মতোই একটা পদ্ধতি। কড়ুইয়ের ফ্রেম এতো বড় তাই দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়া যেতো না। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি হলে, দড়ি দিয়ে বেঁধে পাঁচিল টপকে অনেক কষ্ট করে ভিতরে নিয়ে যেতে হতো। অনেক লোকও লাগতো তার জন্যে। এইসব কঠিন কঠিন কাজ করার সময় তারা মুখে নানা আওয়াজ করতো। গান করতো। ছড়ার মতো করেও অনেক লাইন বলতো। সেগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগতো। কিন্তু উচ্চারণ বুঝতে পারতাম না বলে আমার মুখস্থ হয়নি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কি বলো তোমরা?” বলেছিলো, “শারীরিক পরিশ্রমের কষ্টটা কমানোর জন্য ওইসময় নানান আওয়াজ বেরিয়ে আসে।” এই যেমন, একদল বলে “মারো ঠ্যালা।” অন্যদল বলে, “হেঁইয়ো।” “আরো জোরে, হেঁইয়ো…”।
কিন্তু গান বা ছড়াগুলো জানা হয়নি।
ছোটবেলায় আমার একটা নেশা ছিলো, যেকোনো কাজই মন দিয়ে দেখা। কাঠ কাটা, দরজার ফ্রেম তৈরি, ধানের গাদা দেওয়া, ধান ঝাড়া, ঘরের চাল ছাওয়ার জন্যে খড়ের গোঁজা পাকানো, ধানের আঁটি বাঁধা সব কেমন হাঁ করে বসে বসে দেখতাম, আর ভাবতাম বাপরে কি করে পারে এরা!
শীতলকাকা যখন কাঠের কাজ করতে আসতো, আমি চুপ করে তার কাজ দেখতাম। জল থেকে কাঠ বা তালগাছের কাঁড়ি তুলে এনে সেগুলো ‘বাইশ’ দিয়ে কি সুন্দর মসৃণ করে ছুলে ছুলে দরজা জানলার ফ্রেম বানিয়ে ফেলতো। যন্ত্রগুলোর নামও শেখাতো শীতলকাকা। বাটালি, বাইশ, করাত, ছেনি, হাতুরি আরো অনেককিছু থাকতো তার ব্যাগে।
একটাই প্রশ্ন শীতলকাকা প্রত্যেকবার আমাকে ধরতো। বলতো, “আচ্ছা বলতো, একটা ব্যাগে একশোটা যন্ত্র আছে, তা থেকে ‘বাইশ’টা তুলে নিলে কটা থাকবে?” অঙ্কে খুব ভালো না হলেও, প্রথমে অঙ্কের নিয়ম মেনে বাইশ বিয়োগ করেই উত্তর দিতাম। কাকা ঘাড় নেড়ে বলতো, “উহুঁ হয়নি, হয়নি, ভালো করে ভাবো।” আমিও চিৎকার করে বলতাম, “নিশ্চয়ই হয়েছে, তুমি ভুল বলছো।”
বলতো, “না রে বোকা নিরানব্বইটা হবে, একটা যন্ত্রের নামই তো ‘বাইশ’।” তখন লজ্জা পেতাম। পরে আর কখনো ভুল হয়নি। তবুও প্রত্যেকবার এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতেই হতো। কাকা তার নামের মতোই শান্ত শীতল। এখন সবটাই স্মৃতি।
গ্রামে প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই কড়ুই থাকতো। কড়ুইয়ের খাঁচাটা ঘন করে বুনে, ভিতরে মাটি লেপে দেওয়া হতো, যাতে ধান গলে পড়ে না যায়। বাইরের ডিজাইনটা নানা রকমের হতো। কোনোটা ঠিক বরফির মতো, কোনোটা অন্যরকম। কেউ কেউ আবার বাইরেটাও কাদা লেপে মাটির দেওয়ালের মতো করে ফেলতো। মাথাটা খড় বা টিন দিয়ে ছাওয়া হতো। বেশিরভাগ লোক খড় দিয়েই ছাইতো, তাতে ভিতরটা ঠাণ্ডা থাকতো। ভিতরে ঢোকার জন্যে থাকতো ছোট্ট একটা দরজা। মাটি থেকে একটু উঁচু করে কড়ুই বসানো হতো। তার চারপাশে একটা মাটি বা সিমেন্ট দিয়ে পুরোটা ঘিরে বেদিরমতো তৈরি করা থাকতো। মাটির হলে ওই বেদিটায় প্রতি বৃহস্পতিবার গোবরজল দিয়ে নিকোনো হতো। কড়ুইয়ের গায়ে থাকতো তুলসী মঞ্চ, সেখানে রোজ সন্ধ্যেবেলা ধূপ, প্রদীপ জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে সন্ধ্যে দেওয়া হতো।
শীতের ধান ঝাড়ার পর কড়ুইয়ে রাখার আগে, কড়ুইয়ের ভিতরও নিকিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হতো। ভিতরের দেওয়াল বেশ উঁচু আর নিচটা খুব গভীর তাই নিকোনোর সময় মই লাগে। পরিষ্কার থাকে বলেই কোনো অনুষ্ঠানের আগে যে বাড়িতে মিষ্টি দই পাতা হতো তা কড়ুইয়ের ভিতরে সারারাত রেখে সকালে বের করা হতো। কড়ুইয়ের ভিতর শীতকালেও গরম থাকতো বলে দই জমে যেতো খুব সহজেই।
আমি এখন বাড়িতে দই পাতার সময় মাইক্রোওভেনের ভিতরে বসিয়ে রাখি।
কড়ুইয়ে প্রথমদিন ধান তোলার আগে কিছু নিয়ম ছিলো। একটা ঘট বসিয়ে তাতে জলের মধ্যে আম-শাখা আর সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে কড়ুইয়ের নিচে বসিয়ে দেওয়া হতো। কড়ুইয়ের মধ্যে প্রথমে তিনমুঠো ধান তিনবার দিয়ে, তারপর বাকি ধান তোলার নিয়ম ছিলো। বৃহস্পতিবার কড়ুই থেকে ধান নামানো চলতো না। বাসি কাপড়ে কড়ুই নিকোনো বারণ ছিলো, মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন কড়ুইয়ে হাত একেবারে নৈব নৈবচ।
কড়ুই মাটি থেকে একটু উঁচু হতো বলে তার তলায়, কুকুর, বিড়াল সব আশ্রয় নিতো। একটু বেশি উঁচু হলে আমরাও তার তলায় লুকিয়ে থাকতাম লুকোচুরি খেলার সময়।
কিছুদিন আগে গরমের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। ওপরের বারান্দা থেকে আমাদের উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখি কড়ুইটার খুব করুণ অবস্থা। অনেকটা অংশ মাটিতে প্রায় দেবে গেছে। তাতে আর ধান রাখা হয় না। প্রতি বৃহস্পতিবার নিকোনোর ঝামেলাও নেই। কেউ ধান কিনতে এলে তখন ঠাকুমা যেমন বলতো, মাকে এখন আর বলতে হয় না, “আজ লক্ষ্মীবার, আজ কড়ুই থেকে ধান নামিয়ে ধান বিক্রি করা যাবে না।”
বাড়িতে ধান সিদ্ধ করা, মুড়ি ভাজা, চাল তৈরি, জাঁতায় ডাল ভাঙা, তিলের খোসা আলাদা করার মতো কড়ুইও ইতিহাস।
আজ লেখাটা শেষ করে মাকে ফোন করলাম। মাকে বললাম, “মা তোমার কাছাকাছি কেউ থাকলে তাকে বলো না, কড়ুইয়ের একটা ছবি তুলে পাঠাবে।” মা বললো, “হায় হায়! আমাদের কড়ুই? সে তো ভেঙে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।”
কড়ুই তাই নিশ্চিন্তে ইতিহাস হয়ে রইলো।
Comments
Post a Comment