গাছও কথা বলে
১
স্টেট ব্যাংকে ঢোকার জন্যে ফুটপাথে লাইন। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। ফুটপাথের দোকানগুলো তখনো সেজে ওঠেনি। ঝাঁপ খুলে কর্মচারী, মালিক ঘুম চোখে এক এক করে মাল নামিয়ে সাজানোর চেষ্টা করছে।
আমি যে দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে মোবাইলের ব্যাক কভার, হেডফোন, স্পিকার এইসব বিক্রি হয়। এরমধ্যেই মালিক এসে তার কর্মচারীকে খুব ধমক দিতে শুরু করলেন। “কার থেকে কটা মাল এনেছিস মনে নেই? তোকে কতবার বলেছি লিখে রাখবি। কানে ঢোকে না,না? তুই তো জানিস যেগুলো বিক্রি হয় না তাকে সেগুলো ফেরত দিতে হবে। এখন কোনো মালের লেবেল নেই, কার মাল জানা নেই কি করে ফেরত দেবো?”
কর্মচারী অল্প বয়সী একটা ছেলে। মাথার সামনে বড় বড় লটকা চুল। চোখে এসে পড়ছে, আর মেয়েদের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে চোখ থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছে। চুলে রঙ করা। খুব মিষ্টি মিষ্টি করে হেসে মালিককে বললো, “ভিড় ছিলো খুব।”
মালিক তো রেগে আগুন - “ভিড় ছিলো মানে? ভিড় ছিলো বলে তুই ভুলভাল করবি? কিচ্ছু লিখে রাখবি না? ভিড় থাক। কিছু কাস্টমার ফিরে যায় যাক, তবুও তুই কাজ গুছিয়ে একটাকে ছেড়ে তবে অন্য কাস্টমার ধরবি। আর শোন এবার থেকে সব লিখে রাখবি। কার থেকে কটা মাল আনলি, কটা বিক্রি হলো।” বলে তিনি চলে গেলেন। এ ছেলেটা গান গাইতে গাইতে মোবাইল কভারের প্যাকেটগুলো রিঙে ঝুলিয়ে সাজাতে লাগলো।
একটু পরে ওর বয়েসী আর একটা ছেলে এসে মালের হিসেব নিতে গেলো, ও মুখে আওয়াজ করে তাকে বললো, “চল ফোট, টাকা পেয়ে গেছিস তো। আবার কি।” সে অনেক বোঝাতে চেয়েছিল তার থেকে চারটে মাল এনেছে, তিনটে বিক্রি হয়েছে, একটা ফেরত পাবে সে। এ তাকে “চল, ফোট” করে তাড়িয়ে দিয়ে গান শুরু করছিলো, তখনি মালিক আবার এসে বোঝাতে লাগলেন, “শোন, বেশি বড় নোটগুলো যেমন ৫০০, ২০০০ এই সামনের ড্রয়ারে রাখবি না। ওগুলো সব ভিতরে রাখবি। না হলে কি হবে বলতো? তুই যখন ড্রয়ার খুলে দাম নিবি তখন অন্য কাস্টমাররা টাকাগুলো দেখতে পাবে। তাহলে তোকে ছোট টাকা না দিয়ে খুচরো চাইবে। আর একটা কি সমস্যা বলতো? তুই ধর মাল দেখানোর জন্য ওপর থেকে প্যাকেট নামাতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলি, আর সেই ফাঁকে ফস করে কেউ দুটো সরিয়ে দিলো। বলা তো যায় না! এই কথাটা একটু ফিসফিস করব তার কানের কাছেইই বলতে চেয়েছিলেন।”
সব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন, ছেলেটা আবার গান করতে করতে দোকান সাজাতে লাগলো।
২
ব্যাংকের ভিতরে ঢুকলাম। নিয়ম অনুযায়ী টোকেন কেটে বসে অপেক্ষা। আমার সামনের চেয়ারে তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছিলেন। সকলেই প্রৌঢ়। একটু পরে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সামনের কাউন্টার থেকে ফিরে ঝুঁকে ঝুঁকে সেই চেয়ারের দিকে গেলেন। তিনজনের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে ওনাকে বসার জায়গা করে দিতে চাইলেন। উনি কিছুতেই বসতে চাইলেন না। ইনি অনেক রিকোয়েস্ট করে বসালেন। বললেন পিছনে অনেক জায়গা আছে। জায়গা সত্যিই ছিলো।
উনি বসেও শান্তি পাচ্ছিলেন না। শেষমেশ উনি একটু বাঁদিকে সরে বসলেন। যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি একসঙ্গে ঐখানেই বসলেন।
৩
আমার অনেকদিন ছুটি ছিলো। বাড়ি থেকে প্রায় কোথাও বেরোইনি। কয়েকবার বেরিয়েছিলাম, ওলা আর উবেরে।
আজ ছুটির পরে কলেজে প্রথম দিন। বর গাড়ি করে স্টেশনে নামিয়ে দিলো। অভ্যেসবশতঃ পার্স বের করে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, “দাদা কত হয়েছে?”
৪
বাসে ফেরা। একটি ক্লাস সেভেন-এইটের মেয়ে উঠেই একদিক থেকে সবাইকে “আপনি কোথায় নামবেন? আপনি? আপনি?” জিজ্ঞেস করে নিলো। মোটামুটি সে জেনে গেলো কে কোথায় যাচ্ছে। আমাকেও জিজ্ঞেস করেছিলো। উত্তরও দিয়েছিলাম। কিন্ত সে শুনতে না পেয়ে বললো, “কি? শেষ অব্দি?” আমিও কথা না বাড়িয়ে বললাম “হ্যাঁ”। আমি ততক্ষণে জেনে গিয়েছিলাম যে আমি নামার আগেই সে বসার জায়গা পেয়ে যাবে।
বসতে পেয়েই সে তার পাশের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ওইগুলো কি কাঠ? চন্দন কাঠ? এতো রাখা আছে?” তিনি বললেন, “কোনগুলো?”
“ওই তো ওইগুলো।”
কৌতূহল চাপতে না পেরে তাকিয়ে দেখলাম - ৮বির মতো জায়গায় কতো চন্দনকাঠ দেখি তো। দেখি কিনা, ফল আনার যে কাঠের বাক্সগুলো হয়, সেগুলো ফল শেষ হওয়ার পর ভেঙে ভেঙে এক জায়গার জড়ো করে রাখা।
তারপরেই আবার প্রশ্ন, “আচ্ছা গাছগুলো কি করে?”
মহিলা একটু অবাক - “কি করে মানে?”
“ওই যে ওখানে লেখা, এখানে গাছেও কথা বলে? কি করে কথা বলে?”
এবার আমি পুরো ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, সেটা একটা নার্সারি। সেখানে টবে সাজানো অনেক চারা গাছ। বিক্রির জন্যে রাখা আছে। লেখা আছে “এখানে গাছও কথা বলে।”
মহিলা বোঝাতে থাকলেন - ওগুলো মনে হয় বিক্রির জন্যে রাখা আছে। কিন্তু কেন অমন লেখা আছে জানি না।
আমি মেয়েটার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। শুধু এটাই ভাবছিলাম, যাক, বাংলাটুকু অন্তত পড়তে জানে।
Comments
Post a Comment