জীবনের ওঠাপড়া
মঙ্গলবার দুপুর। সময় দুটো পঞ্চাশ। আমি আর আমার এক কলিগ গল্পে মত্ত ছিলাম। তখন আর এক কলিগ হুড়মুড় করে কাঁধে ব্যাগ নিতে নিতে বললো, “কি গো তোমরা বাড়ি যাবে না?”
আমি বললাম, হ্যাঁ আমি যাবো, তুই একটু দাঁড়া।
সে বললো, “না, তোমার এখনো সই- ফই কিছুই হয়নি, আমি দাঁড়াবো না। এখনই দৌড়ে দৌড়ে যেতে হবে, নাহলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে।”
ট্রেন তিনটে নয়ে, আসে আর একটু দেরিতে। স্টেশন যেতে রিক্সায় লাগে সাত মিনিট মতো। আমি কথায় কথায় সময়টা বুঝতে পারিনি। যার সঙ্গে গল্প করছিলাম, ভাবছিলাম সেও ওই ট্রেন ধরবে, তাই আমি তার উপর ভরসা করেছিলাম। জানা গেলো সে পরের ট্রেন ধরবে। সেই কলিগ চলে গেলো। আর এক দিদিও বেরোচ্ছিলো। বললো, “তুই তাড়াতাড়ি সই করে চলে আয় পেয়ে যাবি, আমি বেরোলাম।” বলে সেও চলে গেলো।
আমি সব গুছিয়ে তড়িঘড়ি রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে অটো, রিক্সা কিছুই পেলাম না। কিছুক্ষণ পর এক রিক্সাওলা এলো।
-- বললাম, যাবে?
-- কোথায়?
-- স্টেশন।
কোনো উত্তর দিলো না। জানতে চাইলাম কত নেবে?
-- কুড়ি টাকা দেবেন।
-- কুড়ি কেন? একা গেলে পনেরো তো?
-- না, কুড়ি দিতে হবে।
তুমি জানো না, রিক্সা স্ট্যান্ড অব্দি গেলে দশ, স্টেশন অব্দি দুজন গেলে কুড়ি, একজন পনেরো। আমি রোজ যাই, আমি জানি। তুমি রিক্সা স্ট্যান্ড অব্দি চলো আমি দশ টাকা দেবো।
-- দশ টাকা তো ওই কালীমন্দির পর্যন্ত গেলেই হয়ে যায়।
-- এতো কথা বোলো না, রিক্সাটা চালাও, ট্রেন মিস করে যাবো। ঝড়ের মতো নিয়ে চলো।
আমি দেখলাম সে মোটে নড়ছে না, কেমন একটা ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে প্যাডেল করছে, মনে হচ্ছে যেন তার মোটে যাওয়ার গা নেই। আর আমি ততক্ষণে উৎকন্ঠায় ঘামতে শুরু করেছি। সে গজগজ করতেই থাকলো।
-- বললাম, গজগজ করছো কেন? তোমাকে ভালো কথা বলছি স্টেশন অব্দি চলো পনেরো টাকা দেবো।
বলতে বলতেই খট করে আওয়াজ। সে রিক্সা থেকে নামলো।
-- কি হলো?
-- চেন পড়ে গেছে।
-- ব্যাস! তুমি তো আমার ট্রেন মিস করিয়েই দেবে!
কিরকম ছোট ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকালো। ভানটা এমন, যেন আমিই চেনটা ফেলে দিয়েছিলাম। চেন লাগিয়ে আবার বসে, সেই ধীরে ধীরে চালাতে শুরু করলো। আমার রাগ জমতে শুরু করলো। আর দু পা গিয়ে আবার খট। তখন তো আমার পুরো মাথায় হাত।
আবার আস্তে আস্তে চালাতে লাগলো। সামান্য উঁচু স্বরে বললাম, ট্রেনটা মিস করে যাবো। একটু জোরে চলো। তখন এক ভ্যানচালক ওকে খুব ধমক দিলো। “একজনকে নিয়ে যাচ্ছিস, জোরে চালাতে পারছিস না, উনি বলছেন ট্রেন মিস করে যাবেন”।
ভাবলাম, এই রে! উনি আবার নাক গলাতে গেলেন কেন? তাতে আমার ভালো হবে নাকি উলটে খারাপ হবে বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে তখন রিক্সাওলা বললো, “ তুমি কি চাও আমি জোরে চালাই, আর চেন পড়ুক?”
আমি চাইবো? তোমার তাই মনে হচ্ছে? ট্রেনটা তো আমাকেই পেতে হবে। বলতে বলতে আবার… এবার পিছনেরটাসহ।
তখন আমার তো রাগ, হতাশা,দুঃখ, কান্না সব একসঙ্গে পেয়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে থাকলাম অটো আসছে কিনা। কিচ্ছু দেখলাম না। চেনটা লাগিয়ে রিক্সায় বসেই শুরু করলো -
-- “মন পরিষ্কার থাকলে সব ঠিকঠাক হয়। আপনার মন পরিষ্কার নেই, তাই এতো ভয় পাচ্ছেন ট্রেন পাবেন কিনা।”
আমি চুপ করে রইলাম। ভাবলাম এর সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
চার নম্বরবার চেন পড়লো।
আমার পুঞ্জিভূত রাগও ঘনীভূত হয়ে
জারণ- বিজারণ যা ঘটানোর সব ঘটিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এলো।
-- বললাম, তোমার মন পরিষ্কার তো, তাহলে এতো চেন পড়ছে কেন?
-- বললো, “যন্ত্রের উপর আমার কি হাত আছে? যন্ত্র যদি খারাপ হয় আমি কি করবো?”
-- বললাম, ও আমার মন পরিষ্কার থাকলে আমি ট্রেনের টাইম আটকে দিতে পারবো, ট্রেনটা যন্ত্র নয়? এটা তোমার নিজের জিনিস তুমি সারিয়ে নিতে পারছো না? মানুষকে বিপদে ফেলবে তো, তোমার রিক্সায় উঠলেই তো বিপদ।
-- আমার রিক্সায় কেউ কখনো বিপদে পড়েনি। বলে স্টেশনের দিকেই এগোতে থাকলো।
-- হুম, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
প্রচণ্ড রাগে ভেবে নিলাম ওকে দশ টাকাই দেবো, ও আমাকে খুব বাজে বাজে কথা শুনিয়েছে, চেন পড়েছে, অনেক ভুগিয়েছে।
স্টেশন এসে দশ টাকা দিতে চাইলাম।
বললাম, তুমি অনেক ভুগিয়েছো। তোমাকে শুরুতে বলেছিলাম, তুমি শোনোনি, নাও দশ টাকা।
সে কেমন একটা করে তাকিয়েছিলো, দেখেই বিরক্ত লাগছিলো। বললো পনেরো টাকা দাও। বললাম, ব্যাগ খোলার সময় নেই।
তখন সে বললো, “টাকাটা তোমার কাছেই রেখে দাও।”
আমিও দুবারের বেশি সাধাসাধি না করে বললাম, বেশ নিতে হবে না। বলে রাগ দেখিয়ে টাকা না দিয়ে ট্রেনের জন্যে দৌড়। স্টেশনে এসে, সেই কলিগ দিদিকে বললাম, জানো তো, এই এই হয়েছে, খুব খারাপ লাগছে।
সে বললো, “তুই এতো রাগ না করে, পনেরো টাকা দিয়ে দিতে পারতিস তো! এবার তোকে সারাটা দিন গালমন্দ করবে।”
বললাম, হুম খুব খারাপ লাগছে।
-- “তুই পরেরদিন দেখলে চিনতে পারবি তো?”
-- হ্যাঁ পারবো।
-- “তাহলে তখন টাকাটা দিয়ে দিস।”
-- হুম এখনই দিতে পারলে ভালো হতো। ভয় লাগছে, ও আমার কোনো ক্ষতি করবে না তো?
-- “ধুর! ক্ষতি করবে না, গালমন্দ করবে এই যা।”
ট্রেন এলো। উঠলাম। সারা রাস্তা সঙ্গী হলো এক খারাপ লাগা। ভাবতে থাকলাম জীবনে এর থেকে অনেক খারাপ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি, অনেক অপমান সহ্য করেছি, যেখানে সত্যিই প্রতিবাদ করার দরকার ছিলো, করিনি। আমার প্রতিবাদী সত্তার উপরেই খুব রাগ হলো। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করে না বলে। কিইইই না, একজন রিক্সাওলার উপর মিছিমিছি দুম করে রাগ দেখিয়ে বসলো। রাতেও ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছে পরেরদিন আগে তাকে টাকাটা দিতে হবে, না হলে শান্তি হবে না।
গতকাল কলেজ যাওয়ার সময় তাকে অনেক খুঁজেছি পাইনি।
ফেরার সময় রিক্সা স্ট্যান্ডে দেখি সে দাঁড়িয়ে আবার চেনের কাছে কি করছে। আমার রিক্সাওলাকে থামিয়ে বললাম, ওই লালজামা পরা রিক্সওলাকে একটু ডেকে আনবে? ও আমার থেকে টাকা পাবে।
সে রিক্সা থামিয়ে ডাকতে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বললো, “ম্যাডাম সে আসবে না, আমার হাতে টাকাটা দিতে বলেছে।”
আমি অবাক! মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “বাপরে!” আমার কলিগ বললো, “আসলে ওর এতো রাগ হয়েছে যে, সে তোমার হাত থেকে নিজে টাকা নিতে চায় না।”
আমি হেসে ফেললাম। তারপর অন্য রিক্সাওলাকে টাকাটা দিয়ে বললাম, তুমি ঠিক দিয়ে দেবে তো?
“হ্যাঁ, ম্যাডাম চিন্তা করবেন না। আমি দিয়ে দেবো।”
“জীবনের নানান ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে।” -- বোরোলীন।
Comments
Post a Comment