দুঃস্বপ্ন

ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফেরার সময় ফকির পাড়া দিয়ে ফিরতাম। খুব জল তেষ্টা পেলে নৌসেরদাদের বাড়িতে গিয়ে বলতাম - বৌদি জল দাও। বৌদি জলের সঙ্গে বাতাসাও দিতো। সেই বাতাসাগুলো ওদের মসজিদের মানত মেটানোর বাতাসা। মানতটা হিন্দু-মুসলিম সবাই করতে পারে। মসজিদটাকে বলাও হয় শাহ-কামালের মন্দির।


নৌসেরদার দিদিকে আমরা আশলে-দি বলি। সে আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই বেড়াতে আসতো। তখনকার দিনে গ্রামের যারা হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে যেতো না, বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করানোর কাজটা আশলেদিই করতো।


আশলেদির এক বৌমার মেয়ে নেই। সেই বৌমা আমাকে বলতো - তুই আমার মেয়ে। আমাকে মা বলে ডাকবি। মেয়ে বলে তাদের প্রতিটা পরবের সিমাই আর নানান খাবার আমার জন্যে রেখে দিতো। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে খেয়ে আসতাম।


স্কুলে আমার প্রিয় বন্ধু ছিলো হাসিবা। কতবার তাদের বাড়ি যেতাম হিসেব দিতে পারবো না। বিশেষ করে পেয়ারার দিনগুলোতে। তাদের বাড়ির উঠোন জুড়ে পেয়ারা গাছ। কোন গাছের পেয়ারা কেমন সেটা আমি দীপিকা, দোলা, রিক্তাদি সবাই জানতাম। তাদের কলকাতায় বেকারি বিস্কুটের কারখানা ছিলো। কলকাতা থেকে আনা অনেক জিনিসও খেতে পেতাম হাসিবার থেকে। সাকিনা, হাসিনা, আকতারাও যেতে বলতো তাদের বাড়ি। উঁচু ক্লাসের দিদি আয়েশাদি তাদের গাছের টক করমচা এনে আমাদের সবাইকে দিতো।


ক্লাস নাইন থেকে তখন একটু দূরের স্কুলে যেতে হতো। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার। প্রথম দুবছর আমার সাইকেল ছিলো না। সকালে কোনদিন টিউশনি পড়া থাকলে তারপর আবার বাড়ি ফিরে খেয়ে এসে স্কুল করা সম্ভব ছিলো না। মাঝে মাঝেই ফতেমা জোর করে টেনে নিয়ে তাদের বাড়ি চলে যেতো। গরম ভাত, ঘি, আলুভাতে, মাছভাজা, পোস্ত ভাজা খেয়ে আবার দুজনে ক্লাসে আসতাম।


ছোটো ছিলাম। একবার বাড়ি এসে জেঠুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম - “সবাই কেন মুসলিমদের বাড়িতে খেতে চায় না?” জেঠু বলেছিলো - “ওই একটা ধর্মীয় ব্যাপার। সবাই ভাবে ওরা গরুর মাংস খাইয়ে দিয়ে হিন্দুদের জাত মারবে। তাই ভয়ে কেউ খেতে চায় না।” আমি বলেছিলাম, “আমাকে তো ওরা গরুর মাংস খাওয়ায়নি, তাতে কি আমার জাত গেলো?” জেঠু বলেছিলো, “এখন ওসব আর কেউ মানে মা। কলকাতায় হিন্দুরাও গোরুর মাংস খায়, আর এখন তো হিন্দু মুসলিম বিয়েই হয়।” আশলেদির ছেলের সঙ্গে আমাদের গ্রামেরই দীপাপিসির বিয়ে হয়েছে।


সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন জার্মান শিখেছিলাম। আমার দুই প্রিয় বন্ধু ছিলো হাফিজুর আর ইবন-এ-হাসান।  হাফিজুর আফ্রিকান, ইবনে পাকিস্তানের। আর ছিলো বাংলাদেশের আবু-দা। পেঁয়াজ দিয়ে রান্না ইলিশ আর অসাধারণ বিরিয়ানি বানিয়ে খাওয়াতো।


পাতাউর আমার খুব ভালো বন্ধু। একেবারে নিজের ভাইয়ের মতো। সে আমার বাড়িতে আসে। নিজের হাতে চা বানিয়ে মাঝে মাঝে দিয়েছে, রান্না করেও এনেছে। দুজনে একসঙ্গে বসে কতবার লাঞ্চ, ডিনার করেছি। আমার জন্যে তার বাড়ি থেকে মায়ের তৈরি আচার, চিংড়ি, দেশি মুরগি কত কি যে খাইয়েছে, ধরে ধরে লিস্ট দেওয়া অসম্ভব। তাদের গাছের শাকসবজি ফল বাদ দিলাম।


যাদবপুরেই আলাপ জিয়াউলের সঙ্গে। কদিন আগেই তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সে পাড়ার সবার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো - “সেলাম ওয়ালেকুম, এইটা আমার দিদি।” জিয়া আমার বাড়ি অনেকবার এসেছে। একবার সময় হয়ে গিয়েছিলো বলে কার্পেট পেতে পশ্চিমদিক জেনে নিয়ে এখানেই নমাজ পড়েছিলো।


আমার দুই ছাত্রী আছে, তারা একেবারে পাগল। তাদের বাড়িতে যখন ঈদের সময় কুরবানির জন্যে গরু কিনে এনে রাখা হয়, সেই গরুর দুধ তাদের খেতে নেই বলে রুহানের জন্যে নিয়ে চলে আসতো। বিরিয়ানি বানিয়ে এনে দিয়েছে। রুহানের জন্মদিনে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে দিয়েছে। আজকেও তাদের একজন অনেক পেয়ারা এনে দিলো। বললো, ম্যাম আপনাকে আগে যে পেয়ারাগুলো দিতাম ওগুলো অফ সিজনের, এগুলো খেয়ে দেখুন কেমন, এগুলো অফ সিজনের নয়।


এগুলো কল্পনা নয়। এগুলোই সত্যি, স্বাভাবিক। আর খবরে যা দেখলাম তা দুঃস্বপ্ন। আজকের এই দুঃস্বপ্ন আর দেখতে চাই না।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত