উত্তরের দরজা

লেখাটা আমার কাছে এখন দিন আনা দিন খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। তাই বেরোতে না পারলে ভালো লাগে না। না বেরোলে আমি মানুষের গল্প শুনতে পাই না। তাদের সুখ দুঃখের কথার সাক্ষী হতে পারি না। এমনকি আমার “মহিলা কামরা”ও ভরে ওঠে না। অচেনা কারোর সঙ্গে গল্প করি না ঠিকই, কিন্তু স্টেশনে যখন দাঁড়িয়ে থাকি তারা নিশ্চিন্তে আমার দিকে তাকিয়ে অনর্গল কথা বলে যায়। আমি ঘাড় নাড়তে থাকি। গল্প চলে।


স্টেশনে এক মহিলা পাঁপড় বেচেন। আমি গিয়ে তার পাশে রাখা কাঠের টেবিলে আমার ভারী ব্যাগটা রেখে দিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকি। সে নিশ্চিন্তে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প বলে যায়। আর মাঝে মাঝে লোক দেখলে হেঁকে ওঠে “দশ টাকা পাঁচ টাকা, দশ টাকা পাঁচ টাকা।” ফাঁকা না হওয়া অব্দি এই চলে। তার কাছে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন শেপের পাঁপড় থাকে। কোনোটা মুসুর ডালের মতো দেখতে, কোনোটা গোল গোল করে কাটা ঢ্যাঁড়সের মতো সবুজ রঙের, কোনোটা বা পাইপের মতো।


একদিন শুনলাম সে বাংলা সিরিয়ালের নাম ধরে ধরে পাঁপড়ের নাম বলে যাচ্ছে। “বোঝে না সে বোঝে না’র পাখি পাঁপড় আছে, তোমায় আমায় মিলে, বধূ বরণ”, এরকম আরো কয়েকটা। সিরিয়াল দেখি না বলে সব নাম বলতে পারলাম না। সব ধরনের পাঁপড় পাবে আমার কাছে। যাহোক নাম মাহাত্ম্যে তার কাছে ভিড় বেড়ে গেলো এবং সে বোঝাতে থাকলো কোনটা কী।


এই মহিলার অনেক গল্প। তার তিন মেয়ে আছে। মেয়ে হওয়ায় কী কী গঞ্জনা শুনতে হয়েছে তাও সে বলেছে। এখন তার বক্তব্য - “আমি দিব্যি আছি গো। আমার মেয়ে জামাইরা সবাই কিছু না কিছু করে। কিন্তু আমি কারো থেকে এক পয়সা নিই না। বলেছি যতদিন গতর আছে খেটে খাবো। তোদের এক পয়সাও আমার লাগবে না।” এখন ছেলের মা, বাপেরই বেশি চিন্তা। কার ছেলে পড়তে যাওয়ার নাম করে কি করে আসছে, কার ছেলে কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হবে বলে টাকা নিয়ে কি করেছে, কার ছেলে গাঁজা-বিড়ি-মদ খায়, সব তার জানা আছে।


আরো গল্প - পাড়ায় হনুমান আসে, সবাই তাদের কিভাবে তাড়ায়, কত মারে, কত ভেংচি কাটে। “তাই তাদের অনিষ্টও করে। আমি তাদের কিচ্ছু বলিনা। রামের বন্ধু তো। হনুমানওতো দেবতা। তাই আমি একটা কলা দিয়ে জোর হাতে প্রণাম করে বলি - ‘পালা, আর আসিস না।’ দিব্যি বোঝে। ওরা সব কথা বোঝে গো। আমার কোনো ক্ষতি করে না। অন্যরা যা করে তাতে তাদের ক্ষতি করাই উচিত।”


মহিলা পাঁপড়ের সঙ্গে তার গাছের কয়েকটা কলা আর বাতাবি নিয়েও বসে। আমি ফেরার পথে দেখতাম সেগুলো যেমনভাবে বসিয়ে রাখতো ঠিক তেমনই থাকতো।


আরো দুজন আছে একজন বয়স্ক সবজিওলা, আর একজন বয়স্ক চায়ের দোকানদার। এই তিনজনেই গল্প করে। নিজেদের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়া আছে, তাই কেউ একজন না থাকলে একে অন্যের জিনিস বিক্রি করে দিতে সাহায্য করে।


এই দাদুর চায়ের দোকানের মাচায় গিয়ে রোজ বসতাম। চা বা বিস্কুট কিনে খেতাম না তাই বসতে কিন্তু কিন্তু লাগতো। তবুও কিন্তুকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাগের ভার লাঘব করতাম। স্টেশনে শেড হবে বলে দেখি একদিন সব ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। দাদুর মাচাও নেই। বহুদিন পর দাদু আবার একটা কাঠের ডেস্ক তৈরি করে স্টেশনে বসতে শুরু করেছে। একদিন একজনের সঙ্গে চায়ের হিসেব নিয়ে তুমুল হয়ে গেলো। সে লোকটা এমন ভান করলো যেন দাদুকে জিতিয়ে দিলো। অনেক দিদিমণি গিয়েই দাদুর দোকান থেকে চা আর টোস্ট বিস্কুট কিনে খায়। দাদু ঠিক বারোটার আগে সব গুছিয়ে তার ডেস্ক বন্ধ করে দুপুরে খেতে যায়, আবার বিকেলে আসে।


স্টেশনে থাকে আর একদল অবাঙালী মহিলা। তারা পুরোনো জামা কাপড় নিয়ে প্লাসটিকের গামলা, বালতি, ঝুড়ি দেয়। ট্রেনে ওঠার সময় তাদের ওই বিশাল পোঁটলার ধাক্কার অভিজ্ঞতা সবারই আছে। ওদের মধ্যে একজন আছে যে, ট্রেন না আসা অব্দি পুরোনো জামা-কাপড় ঢেলে অনেককেই বিক্রি করতে থাকে। ধারেও বেচা-কেনা হয় তার। তাদের ভাষা ভোজপুরি হবে। হিন্দির কাছ ঘেঁষা পুরো হিন্দি নয়। তবে ওই মহিলা বাংলা ভাষাও বলতে পারে।  বাংলায় গালাগালটাও ভালো দেয়।


শরীর খারাপের দিনে স্মৃতির উষ্ণতা পায় এইসব মুখেরা। স্টেশন দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাগলটা অথবা পাগল বুড়িও আমার স্মৃতি ছুঁয়ে যায়।


পাগলটা মাথায় করে অনেকের মাল বয়ে দিয়ে পয়সা পায়। পুরোনো জামা কাপড় বেচা মহিলা তাকে অনেক জামা প্যান্ট দেয়। একদিন কোনো কারণে তার মেজাজ খুব খারাপ থাকায় সে প্রচণ্ড গালাগাল দিচ্ছিলো। তখন এক বয়স্ক মহিলা বললেন, “এই শোন এদিকে? এই পয়সাটা নিয়ে যা, চা কিনে খাবি।”


খুব নোংরা শাড়ি পরা পাগল বুড়ির কাছে থাকে একটা পোঁটলা। তার মধ্যে কি থাকে আমি জানি না, কিন্তু সে বিড়ি খায়। দুকানে বিড়ি গোঁজা থাকে। একদিন দাঁতের গর্তের মধ্যে জ্বলন্ত বিড়ির ছ্যাঁকা দিচ্ছে। আন্দাজ করলাম পোকা দাঁতের কষ্টের হাত থেকে রেহাই পেতেই এই অভিনব পদ্ধতি। সেই বুড়িকে এখন আর স্টেশনে দেখি না। এখন থাকে প্রিন্স আনোয়ার শা’র বাঁকের মুখে। কোনদিন আবার হয়তো এ ঠিকানাও বদলে ফেলবে।


এমনি করেই সব স্মৃতি হয়ে যায়। স্মৃতি হয়ে যায় প্রিয় মানুষজন। আজকের দিনটাও আমার কাছে একটা স্মৃতি। কোন ছোট্ট বয়সে ভোরের অন্ধকারে দৌড়ে দৌড়ে দোকানঘরে দাদাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম - দেখবে চলো বাবা কেমন করছে! ফিরে এসে কেমন করাটুকু আর দেখতে পাইনি।


তার আগে মাকে কোনোদিন অসুস্থ হতে দেখিনি। শুধু সেইদিনই দেখেছিলাম ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারাতে।


দুপুরে মাকে ফোন করলাম। রিঙ হয়ে গেলো। একটু পরেই মা ফোন করলো। বললাম, “ধরলে না কেন? ভাত খাচ্ছিলে?” বললো - “না, ভাত খাবো না আজ একাদশী। উত্তর দিকের দরজায় বসেছিলাম।” বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, “কেন বসেছিলে?” বললো - “এমনি।” তারপর বললো, “জানিস আজ তোর বাবার মৃত্যুদিন?” বললাম, ‘
“জানি! তুমি আর দেরি কোরো না, যা খাবে খেয়ে নাও। দেড়টা বেজে গেছে।”


এখন স্মৃতি হাতড়েই পেলাম - মা উত্তর দিকের দরজায় কোনো ‘উত্তরে’র আশায় বসে ছিলো না। ওটা তার অনন্ত অপেক্ষা, যা আজও করে যায়। আমাদের বাড়ির কেউ মারা গেলে উত্তর দিকের দরজাতে বসেই দেখা যায় ধোঁয়া উড়ে আকাশে মিশতে থাকে! একানব্বই সালে এই দিনেও ধোঁয়া মিশেছিলো। মা আজও চোখে ধোঁয়া দেখে।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত