গব্বর সিং
টাকারা বদলায় হাত
গদিরা মন্ত্রী।
ঘুড়িরা ছেঁড়ে সুতো
তুমি আমি কিন্তু
সেই লাটাই।
চুরি কে না করে? ছোটবেলায় আমিও করেছি। আমার মা’ও করেছে।
দুপুরবেলার নিস্তব্ধতায় বড় জেঠুর নাক ডাকাকে বাঁচিয়ে রেখে আমি আর আমার দলবল তেঁতুল চুরি করতাম। আমিই ছিলাম দলের হেড। বাকিরা আমার থেকে ছোটো।
মজন্তালি সরকারকে মনে আছে? সে বাঘিনী আর তার বাচ্চাদের ঝাঁপে পাঠিয়ে নিজে খাপে লুকিয়ে থাকতো। গল্পটা না জানা থাকলে পড়ে নিও, না পড়লে খুব মিস করবে। মজন্তালি সরকারের মতো আমরাও খাপে আর ঝাঁপে থেকেই চুরিটা করতাম। পাছে জেঠুর ঘুম ভেঙে যায়, তাই পুরো নিঃশব্দে কাজ। আমি কখনো ঝাঁপে থাকতাম না, ওই ঝাঁপাঝাঁপির ভয়ে খাপেই থাকতাম। নির্দেশ দিতাম চৌকির নিচের কোন মাটির হাঁড়িটা থেকে তেঁতুলটা নিতে হবে। যে তেঁতুল যত পুরোনো সে তেঁতুল তত কালো আর স্বাদেও অতুলনীয়। যারা এই স্বাদের মধ্যে দিয়ে না গেছে, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
আমাদের বাড়ির মা, জেঠিমারা সবাই, আমাদের ছোটদের ভয়ে খাটের তলায় তেঁতুল লুকিয়েই রাখতো। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারতো না। রোজই তেঁতুল, নুন, সরষের তেল, কাঁচালঙ্কা চুরি যেতো।
আমাদের গাছের কাগজি লেবু, সেটাও দুপুরের নিস্তব্ধতাতেই চুরি করে খেতে হতো। কয়েৎবেল, টোপাকুল সবই ছিলো আমাদের চুরি করা অস্থাবর সম্পত্তি।
বাড়িতে কেউ এলেই চা করে দিতে হতো। চায়ের জল বসিয়ে দিয়েই প্রধান কাজ ছিলো - গুঁড়ো দুধের কৌট খুলে প্রথমেই এক-দু চামচ মুখে ভরে দিয়ে নীরবতা পালন।
আমার মা’ও ছোটবেলায় একবার গুঁড়োদুধ চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছিলো। মেজোমামা দেখে ফেলে জিজ্ঞেস করেছিলো, “মানি কি খাচ্ছিস?”
মা বলেছিলো, “জল খাচ্ছি।”
মামা বলেছিলো, “ও, তুই বুঝি জল চিবিয়ে খাস?”
তখন মা হেসে ফেলেছিলো, আর কোনো উত্তর দিতে পারেনি। এই গল্প আমরা শুনে এসেছি, এখন আমার ছেলেও শোনে। শুনে বলে, “দিদুন পুরো ‘জনি জনি ইয়েস পাপা’র মতো করেছে।”
একবার আমার টাকাও চুরি গেছিলো। সাড়ে তিন টাকা। এখন যেগুলো পিগি ব্যাংক বলি ছোটবেলায় সেগুলোকে বোকাভাঁড় বলতাম। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তা থেকে ওই টাকাটা চুরি গেছিলো। ইংরেজির স্যারকে বলেছিলাম টাকা চুরির কথাটা। তিনি শুনে বলেছিলেন ওটায় বোকারা টাকা জমায় তাই ওটার নাম বোকাভাঁড়। ভাঁড়টা বোকা নয়। বুঝলাম আমার টাকা চোরটা চালাক ছিলো।
পরে অনেক বিয়েবাড়িতে আমি ঘড়ি, জুতো, রুপোর নুপুর খুইয়েছি, নিজের উদাসীনতাকে সম্মান করে।
কিন্তু লোকে বলে ছোট ছোট চুরি দিয়েই বড় চুরি, ডাকাতি শেখে। আমাদের পাশের গ্রামের কয়েকজন এমন অনেক চোর, চোর থেকে ডাকাত হয়ে গেছিলো। সেটা বহু আগে।
গ্রামে একটু অবস্থাপন্ন সবার বাড়িতেই তখন বন্দুক থাকতো। আমাদেরও ছিলো। সে গল্প আর একদিন হবে। কিন্তু থাকতো একটাই কারণে একজনের বাড়িতে ডাকাতি শুরু হলে, ফাঁকায় গুলি চালিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হতো। অ্যাসিডও থাকতো ডাকাতদের গায়ে ছোঁড়ার জন্যে।
আমাদের বাড়িতে এমন অনেকবার ডাকাতি হয়েছে। কোনবার কিভাবে ডাকাতি হতো, কিভাবে ডাকাতরা আসতো। সেজদাদুকে কোথায় বেঁধে রেখেছিলো, মায়ের গয়নাগুলো কেনো নিতে পারেনি, সব শোনার পর আমার ভয় না করে ডাকাতি দেখতে ইচ্ছে করতো। যার কাছেই গল্প শুনতাম তাকেই বলতাম আমার ডাকাতি দেখতে খুব ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করতো একটাই কারণে তারা শারীরিক ক্ষতি না করে, শুধু টাকা পয়সা, থালা-বাসন নিয়ে চলে যেতো বলে। এই ভদ্রতার জন্যেই দেখার ইচ্ছে হতো। জিজ্ঞেস করতাম তারা কেমন দেখতে? বলতো মুখ তো ঢাকা থাকতো দেখবো কি করে? কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে আসতো, চোখের কাছে ফাঁকা থাকতো।
আমার ডাকাতি দেখার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করলে - সবসময় একটা উত্তরই পেতাম। আনু ডাকাতকে যখন মেরে ফেলা হলো, তারপর থেকে আমাদের এখানে আর ডাকাতি হয় না। আনু ডাকাত কে, কোথায় বাড়ি আমার আর মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে সে আমাদের গ্রাম, আমাদের পাশের গ্রামগুলোর ডাকাতির সর্দার ছিলো।
সত্যি সত্যি যে চুরির গল্পে খুব ভয় পেতাম, সেটা ছেলেধরার গল্প। রোজ দুপুরবেলা কেউ না কেউ ভয় দেখিয়েই থাকতো, ঘুমিয়ে পড়, না হলে ছেলেধরা আসবে। ছেলেধরা মানে যারা বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখতে পেলে বস্তায় ভরে নিয়ে চলে যায়। ঘুমিয়ে পড়তাম তাই কোনদিন ছেলেধরা দেখা হয়নি। তবুও আমাদের একজনকে আমার ছেলেধরা মনে হতো। সেই দাদা দুপুর আর বিকেলের মাঝের সময়টায় আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা বস্তা নিয়ে রোজ কিছু একটা কিনতে যেতো।
আমার মেজোজেঠুও তার নাতিকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো --
“কালো সোনা নন্দী,
আঁটে বড়ো ফন্দি।
ব্যাগ নিয়ে ঘোরে,
দুষ্টু ছেলে ধরে।”
এখন বাড়িতে বসেও রোজ চুরি ডাকাতির গল্প শুনি। পার্কে হাঁটতে গিয়ে হার ছিনতাই, বা বাইকে বসে থাকা মহিলার গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে চম্পট -- এগুলো তো বস্তাপচা। এখন রোজই শোনা যায় অনেক অভিনব পদ্ধতি।
আস্ত শিশু চুরি। কেউ বলছে পাচার। কেউ বলছে চুরি। কেউ বলছে চালান। এসব কাণ্ডে বড় বড় বাড়ি, গাড়িও হয়েছে। টিভিতে দেখালো। তবে ডাকাতি কেউ বলে না।
মনে হয় এখনকার আনু ডাকাতকেও বুঝি কেউ মেরে দিয়েছে। তাই হয়তো আর শিশু ডাকাতি হয় না।
Comments
Post a Comment