এই একটু আশেপাশে
ডাক্তারখানা গিয়েছিলাম।
গিয়ে দেখি চারজন ইতিমধ্যে বসে, আমি পাঁচ। ডাক্তারবাবু ভিতরে একজনকে দেখছেন।
আমি যে চেয়ারে বসলাম তার ডানপাশে বছর ষাটের এক মহিলা, তাঁর ঠিক উল্টোদিকে বছর পঞ্চাশের আর এক। দুজনেই বেশ সুন্দর দেখতে। তাঁদের গল্পের বিষয় - এখন ছেলেমেয়েরা কি করে, বাড়িতে টাকা পয়সা দেয় কিনা… ইত্যাদি ইত্যাদি।
বছর পঞ্চাশের যিনি তিনি বললেন - “আমাদের টাকার তো দরকার নেই, তারা নিজেরা যা আয় করে তারা তাদের মতোই খরচ করে, তাদের মতোই থাকে।” তাতে বছর ষাটের মহিলার conclusion - “আমরা বাবা এরম ভাবতে পারি না! আজকালকার ছেলেমেয়েরা সত্যি!! হতাশ হয়ে গুছিয়ে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন।”
আমি ফেসবুক খুলে এটা সেটা দেখছিলাম। খেয়াল করলাম, উনি মন দিয়ে দেখছেন। একটু পরে তাকিয়ে দেখি উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তার একটু পরে উল্টোদিকের মহিলা উঠে এসে আমার বাঁ পাশে বসলেন। আমি নিজের মনে ফেসবুক স্ক্রল করেই চলেছি। উনি হঠাৎ বললেন - “দেখি, এই কানেরদুল আর হারটা একটু দেখে নি।” আমি থেমে সবকটা একটা একটা করে দেখালাম। তারপর অন্য দুটো সাইটের আরো কিছু কানের দুল আর শাড়ির ছবি দেখালাম। উনি খুব মন দিয়ে দেখে বললেন, “ভালো। এগুলো কি সব তুমি নিজে বানিয়েছো? নাকি কেউ পাঠিয়েছে?” বললাম, “না না, আমি কিছু করিনি। এগুলো সব অনলাইন বিজ্ঞাপন।” বললেন -- “আচ্ছা।”
তারপর বললেন “আমি শুধু একটা রিপোর্ট দেখাবো, দেখিয়েই চলে যাবো। এক্ষুণি হয়ে যাবে।” উনি আমার আগে গেলেন।
আমার ডাক এলো। গেলাম। ডাক্তারবাবু দেখলেন। দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিলেন। টাকা দিতে গিয়ে বললাম -- “আমার বিল লাগবে ডাক্তারবাবু।”
তিনি অবাক হয়ে বললেন “বিল কিসের?! টাকাই তো লাগবে না!”
আমি বললাম “মানে? কেন? আপনি তো দেখলেন?”
তিনি বললেন - “না লাগবে না। একই রোগ দুদিন দেখছি। আমার একটা ethics আছে। আর তাছাড়া আমি একেবারে কপর্দক শূন্য নই তো নাকি? আমি একজন নর্মাল ডাক্তার, উকিল নই, যে কথায় কথায় টাকা লাগবে! আমার এতো টাকা কি হবে? প্রায় তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে, ছেলেও বড় হয়ে গেছে। তাদের সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে টাকা লাগবে না। তাদের মা’ও প্রচুর টাকা ইনকাম করে। মেয়েও দুদিন পর ইন্দোনেশিয়া যাবে চাকরি করতে। মেয়ের বয়েস শুনে বুঝলাম আমাকে কতটা কচিখুকি দেখায়।”
তিনি আরো অনেক কিছু বোঝালেন। আমি হাঁ করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলাম, হতবাক হয়ে যাওয়ায় কথা আসছিলো না। তারপর একবার শুধু বললাম, “এমন ওষুধ দিন যেন সব দোকানে পাওয়া যায়।” এটা নিয়েও কিছু কথা হলো। আমি আগের দিন অনেক ঘুরে শেষে এইট বি গিয়ে ওষুধটা পেয়েছিলাম। তিনি বললেন, “আজ অসুবিধা হবে না।”
ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়েই ওটার কাছাকাছি ওষুধের দোকানটাতেই আগে গেলাম। ডাক্তারখানার কাছাকাছি যে ওষুধের দোকান থাকে তাতে সেই ডাক্তারের লেখা ওষুধ কিনতে খুব একটা নাজেহাল হতে হয় না। গিয়ে দেখি দোকানদার একজনকে ওষুধ দিয়ে কুড়ি টাকা ফেরৎ দিতে পারছেন না। সেটার জন্যে হন্যে হয়ে এই ড্রয়ার সেই ড্রয়ার খুঁজেই চলেছেন। আমি এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা বুঝে ওনাকে বললাম -- “আমার প্রেসক্রিপশনটা দেখুন না, যদি ওষুধগুলো থাকে আমি ওনাকে কুড়ি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।” একবারে বুঝতে পারলেন না, দুবার বললাম। তিনবারের বার একটু জোর দিয়ে বলতে তিনি আমার হিসেবটা বুঝলেন। আর বাকি দুজন customer হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ভাবলেন এমন আজব প্রাণী কোথা থেকে এলো! দোকানদার আমার প্রেসক্রিপশন দেখে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। আমি ওই মহিলাকে কুড়ি টাকা দিয়ে দিলাম। তিনিও হাঁ হয়ে চলে গেলেন।
তারপর দোকানদারের সহকর্মী এলেন। আসার পরেই তিনি অন্য কাস্টমারদের দেখার চেষ্টা করলেন। আর দোকানদার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে খুব গজগজ করতে লাগলেন -- “ধ্যাৎ বড্ড বিরক্ত লাগে কতবার বলে বিড়ি খাবি না, বিড়ির গন্ধ আমার একেবারে সহ্য হয় না! সিগারেট হলে তাও সহ্য করা যায়।” উনি লজ্জায় বোঝানোর চেষ্টা করছেন তিনি বিড়ি খাননি। আর ইনি কিছুতেই থামার নন। তখন আমি বললাম -- “দাদা আমার ওষুধ, আর বিলটা…”
-- “হ্যাঁ হ্যাঁ দিচ্ছি। আপনি তো ওনাকে দশ টাকা দিলেন? তাহলে আমাকে দশ কম দেবেন।” বুঝলাম বিড়ির গন্ধে ওনার সব গুলিয়ে গেছে!
আমি বললাম -- “না, কুড়ি।”
উনি বললেন, “আপনি ওনাকে কুড়ি দিয়েছেন?”
বললাম -- “হ্যাঁ। আপনি কুড়ি টাকাই খুঁজছিলেন, তারপর কুড়িই দিতে বললেন।”
তখন বললেন -- “ও হ্যাঁ…. কুড়ি। ঠিক আছে কুড়ি কম দিন।”
এখন বসে বসে “বাইশে শ্রাবণ” দেখছি। তাতে আবির চ্যাটার্জি পাগলা কবিকে বলছে -- “এই মুহূর্তে কাউকেই বিশ্বাস করবেন না, তাতে রবীন্দ্রনাথই হোক বা নজরুল!!”
Comments
Post a Comment