সংক্রান্তির কাহিনী
গরুর গাড়ির ক্যাঁচক্যাঁচ, গরু মোষের ঢিমে তালে চলন, মুনিষের হনহন দৌড়েই চাষীর খামার ভরে ওঠে ধানে। ঠিক অঘ্রাণের মাঝ থেকে শুরু হয়ে যায় ধান কাটা। ভোরবেলা টিনের চালে হিমের টুপটাপ আওয়াজ। কিছুদিন পর শিশিরের টুপটাপকে ছাপিয়ে যেতো ধান ঝাড়ার আওয়াজ আর লেবারদের গুঞ্জন।
ধান কাটার পরে সেগুলো আঁটি বেঁধে মাঠেই কিছুদিন সাজিয়ে উঁচু করে রেখে দেওয়া হয়। শেষ দিক থেকে পৌষের শুরুতে সবাই মোটামুটি মাঠ থেকে ধান তোলা শেষ করে ফেলে। প্রথমে খামারে এনে জমা করে, তারপর সেগুলো নিয়ে গাদা দেওয়া হয়। গাদা সবাই দিতে পারে না। দেওয়ার একটা কায়দা আছে। তাই ধান কাটা বা তোলার জন্যে অনেক লোক নিয়োগ হলেও গাদা দেওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একজন থাকেই সব বাড়ির। আমাদের ছিলো সোনাকাকা।
এইসময় বাড়ির চারপাশ, উঠোন, খামার সবই খুব ঝকঝকে পরিষ্কার থাকে। বৃষ্টির গল্প থাকে না। আর পরিষ্কার জায়গাতেই ধান তুলতে হয়। গোবর জলের গোলা দিয়ে সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। এই গোলা দেওয়ারও একটা পদ্ধতি আছে। সবাই পারেনা। ঝাঁটা দিয়ে সুন্দর গোল করে জলটা টেনে নিতে হয়।
পুকুরপাড়ের রোদ পেত অলস পিঠ। কেউবা খেত ভাত। কেউ বা লেপমুড়ি দিয়ে দিতো টানা একটা ভাত ঘুম। একদম সকালে কেউবা খড়কুটো জ্বালিয়ে সেঁকে নিতো হাত।
এইসময় বাড়ির চারপাশ, উঠোন, খামার সবই খুব ঝকঝকে পরিষ্কার থাকে। বৃষ্টির গল্প থাকে না। আর পরিষ্কার জায়গাতেই ধান তুলতে হয়। গোবর জলের গোলা দিয়ে সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। এই গোলা দেওয়ারও একটা পদ্ধতি আছে। সবাই পারেনা। ঝাঁটা দিয়ে সুন্দর গোল করে জলটা টেনে নিতে হয়।
পুকুরপাড়ের রোদ পেত অলস পিঠ। কেউবা খেত ভাত। কেউ বা লেপমুড়ি দিয়ে দিতো টানা একটা ভাত ঘুম। একদম সকালে কেউবা খড়কুটো জ্বালিয়ে সেঁকে নিতো হাত।
এইসময় থেকে হালকা হালকা ঠাণ্ডা শুরু হয়। ভোরে টুপটাপ টিনের চালে শিশিরের শব্দে ঘুম ভাঙতো।
ছোটবেলায় আমাদের আনন্দ ছিলো সব বাচ্চারা মিলে ধানের গাদার অলিতে গলিতে লুকিয়ে লুকোচুরি খেলা। নতুন ধানের গন্ধে চারদিক ম ম করতো। প্রতি রবিবার মেয়েরা নিয়ম করে সেরে নিতো ইতু পুজোটা।
ছোটবেলায় আমাদের আনন্দ ছিলো সব বাচ্চারা মিলে ধানের গাদার অলিতে গলিতে লুকিয়ে লুকোচুরি খেলা। নতুন ধানের গন্ধে চারদিক ম ম করতো। প্রতি রবিবার মেয়েরা নিয়ম করে সেরে নিতো ইতু পুজোটা।
ইতু
----
অঘ্রাণের সংক্রান্তিতে ইতু ঠাকুর তোলা হয়। ইতুর জন্যে অনেকরকম শিকড়সহ গাছ জোগাড় করতে হয়। শুশনি, কলমী, কচু থেকে শুরু করে আরো বেশ কয়েকটা। আর লাগে একটা মাটির সরা বা মালসা। কেউ কেউ পিতলেরও নেয়। চান করার সময় ডুব দিয়ে একমুঠো মাটি তুলে সরায় রাখতে হয়। তিনবার ডুব দিয়ে মাটি তুলে সরায় রেখে বাকিটা এমনি মাটি দিয়ে সরা ভর্তি করে শিকড়সহ গাছগুলো পুঁতে দিতে হয়। গাছগুলোর মাঝে একটা আমশখা পুঁতে দিয়ে, সরার গায়ে সিঁদুর দিয়ে একটা স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দেয়। তারপর এটা পুকুরঘাট থেকে মাথায় করে এনে বারান্দায় কুলুঙ্গিতে অন্যান্য ঠাকুরের পাশে বা যেখানে রোদ পায় এমন তাকে রাখা হয়। গোটা অঘ্রাণমাস ধরে পুজোটা করতে হয়। প্রতি রবিবার ভোগ দিয়ে, আর রোজ এমনি জল দিতে হয়। গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিছু শুকনো কলাই - ছোলা, মটর, মুগ, মুসুর সরায় ছড়িয়ে দিতে হতো। তারপর সেগুলো কিছুদিন পর অঙ্কুরিত হয়ে শেষে বড় বড় গাছ হয়ে যায়। তখন সরাটাকে দেখতে দারুণ লাগে। মাসের শেষদিনে ভোগ করে বড় করে পুজো করে ভোরবেলা জলে ভাসিয়ে দেয়। ভাসিয়ে দিয়ে ওই দিনেই কেউ কেউ আবার তোষলা তুলতো। আবার গোটা পৌষ মাস তোষলা পুজো করে সংক্রান্তিতে ভাসিয়ে দিতে হয়। এটা একটু কঠিন তাই সবাই করতো না। ইতু পুজোটা মা, কাকীমা, বৌদি সবাইকেই করতে দেখেছি।
ইতুর মন্ত্র ছিলো -
শুশনি কলমি লকলক করে,
রাজার ব্যাটা পক্ষ মারে,
মারুক পক্ষ শুকোক বিল,
সোনার কৌট রূপোর খিল,
রাজার ব্যাটা পক্ষ মারে,
মারুক পক্ষ শুকোক বিল,
সোনার কৌট রূপোর খিল,
গুটি গুটি চন্দনের বাটি,
বেড়ায় চাঁপাফুল,
এই নিয়ে তুষ্ট হও
বাবা ইতু ঠাকুর,
ইতু ঠাকুরকে চাই বর,
ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।
পৌষ সংক্রান্তি
----------------
পৌষ মাসের সংক্রান্তির আগেরদিনে হয় বাউনী আর পৌষ পুজো। সংক্রান্তিতে মকর। মকরের দুধ কলা দিয়ে মাখা আতপচাল অনেক বাড়ি থেকেই দিয়ে যেতো। খেতে বেশ ভালো লাগতো।
পৌষ মাসের সংক্রান্তির আগেরদিনে হয় বাউনী আর পৌষ পুজো। সংক্রান্তিতে মকর। মকরের দুধ কলা দিয়ে মাখা আতপচাল অনেক বাড়ি থেকেই দিয়ে যেতো। খেতে বেশ ভালো লাগতো।
পৌষ পুজো সব চাষীর বাড়িতেই হয়। ধান কাটার সময় এক গোছা ধান, না কেটে শিকড়, মাটিসহ তুলতে হয়। সেটা মাথায় করে বা গরুর গাড়ির ধানের ওপরে করেই নিয়ে এসে গাদায় তুলে রাখা হয়। তারপর সেটা সংক্রান্তির আগের দিন কোনো এক সময় সুন্দর করে বাঁধতে হয়। এটাকে বলে পৌষ। খড়ের সঙ্গে আমপাতা দিয়ে বিনিয়ে তৈরি করা হয় বাউনী। সন্ধ্যেবেলা পৌষ আর বাউনী একসঙ্গে পুজো করে, পৌষটাকে খড়ের গাদায় বা ধানের গাদায় তুলে রাখতে হয়। বাউনীগুলো এনে চালের গুঁড়ি, রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়ির পাশে, আর চালের বাতায় গুঁজে রাখতে হয়।
বাউনী সবাই বাঁধতে পারে না, এটা বাঁধার একটা ধরণ আছে। কেউ কেউ সৌখিনতাও বজায় রাখার চেষ্টা করে। আগে আমার সেজদাদু বাঁধতো। পরে এক কাকু। সে খুব সুন্দর বাউনী বাঁধতে পারে। পৌষ বাঁধাটাও তাই, সবাই পারে না। পৌষের দুদিক দিয়ে ধানের শিষ বেরিয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা হাঁসের মতো লাগে। আর বাউনী বাঁধা হয় আমপাতাসহ ভেজা খড়ের বিনুনি করে।
বাউনী পুজোয় লাগে সরষে ফুল। আর সিঁদুর। বাউনীর মন্ত্র সেজদাদু ভাইকে শেখাতো - “আউনী বাউনী তিনদিন পিঠেভাত খেও, কোথাও না যেও।” ভাই সেটা পুজো করার সময় বলে আসতো - “আউনী বাউনী তিনদিন পিঠে ভাত খাউনী, কোথাও যাউনী।” আমরা দল বেঁধে সরষেফুল তুলতে যেতাম। ওই সময় হলুদ রঙের জামা পরা যেতো না। তাহলে সরষেফুল ভেবে একধরনের ছোট ছোট নরম পোকা পুরো ছেঁকে ধরতো। ওই পোকাগুলো খুব চোখে ঢুকে গিয়ে পাগল করে দিতো। এমনকি যতদিন সরষে গাছ থাকতো ততদিনই পরা যেতো না।
উঠোন লক্ষ্মীর পুজো
-----------------------
সংক্রান্তির দিনে বা মাঘ মাসের পয়লা হয় উঠোন লক্ষ্মীর পুজো। উঠোনে মড়াইয়ের তলায়। ওইদিন পৌষটাকে গাদা থেকে নামিয়ে মাথায় করে এনে উঠোনে লক্ষ্মীর সঙ্গে রেখে আবার পুজো করা হয়। পুজোর কদিন পর তার থেকে শিষগুলো বের করে নিয়ে খড়টা জলে ভাসিয়ে দিতে হয়।
উঠোন লক্ষ্মীর পুজোটাও বেশ মজার। আমার খুব ভালো লাগতো। কোনো কোনো বাড়িতে হয় পৌষের সংক্রান্তিতে, আবার কোনো বাড়িতে মাঘের পয়লা। আমাদের পয়লা। আর আমার এক পিসিদের হয় সংক্রান্তিতে। তাই ডবল মজা পেতাম। মজা তখনই হতো যদি আল্পনাটা আঁকতে দিতো। না হলে আলাদা করে আমার মজার কিছু থাকতো না। কারণ আল্পনাটায় গোটা উঠোন জুড়ে বেশ অনেক কিছু আঁকতে হয়। লক্ষ্মীর নানান গয়না - হার, কানের দুল, চুড়ি, বালা, মই, গরু, লাঙল, জোয়াল চাষের সমস্ত উপকরণ। এছাড়াও লক্ষ্মীর পা। লক্ষ্মীর পা আঁকা শুরু হয় যেখানে নারায়ণ রাখা থাকে সেখান থেকে শুরু করে উঠোনে পুজোর জায়গা অব্দি। যে গাদায় পৌষ তোলা থাকে সেখান থেকে পৌষ মাথায় করে আনতে হয় বলে ওখান থেকেও লক্ষ্মীর পা একেঁ একেঁ আসতে হয় পুজোর জায়গা অব্দি।
পুজোর প্রসাদের জন্যে থাকে শীতের সমস্ত ফল। খইয়ের মুড়কি, তিল দিয়ে তৈরি গুড়ের পাটালি। এই তিলে পাটালিটা ওইদিন খেতেই হয়, না খেলে নাকি দিন বাড়বে না। সবাই বলতো ওইদিন থেকেই একতিল একতিল করে দিন বাড়তে থাকে। তখন কেউ অতো ভূগোলের আহ্নিকগতি বার্ষিকগতির ধার ধারতো না। ফলের মধ্যে বিলিতি কুলের বীজটা যার ভাগ্যে পড়তো সে হতো লাকি। তার এক্সট্রা আনন্দ। পুজো শেষ হলেই উঠোন থেকে ঠাকুর তুলে নেওয়া যেতো না। রাতে পেঁচার ডাক শুনে তবে ঠাকুর তুলতে পেতো। তার জেগে বসে থাকতো ঠাকুমা। গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনে, ঠাকুর তুলে, নিকিয়ে সব পরিষ্কার করে তবে ঘুমোতে যেতো। পরেরদিন জিজ্ঞেস করতাম ডাক শুনেছিলে? কখন শুনেছিলে?
আমাদের পুরোহিত আসে একটু দূরের গ্রাম থেকে। এখন পুজো করে দেবুকাকা, আগে তার বাবা করতো। তাকে আমরা দাদু ডাকতাম। আমরা ওত পেতে বসে থাকতাম পুজোর জন্যে। পুজো হলে তবেই তো কুলের বীজটা পাবো, তিলের পাটালি। একবার মদনদাদু পুজো করতে এসে, মদ খেতে চলে গেছিলো। সবাই অপেক্ষা করছে, অনেক রাত হয়েছে, আমরা ছোটরাও ধৈর্য হারাচ্ছি, তখন খবর এলো মদনদাদুর অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। তার পায়ের তলায় চুন লেপে, মাথায় জল ঢেলে হুঁশ ফেরানোর চেষ্টা চলছে। প্রায়দিনই তাই চলতো। মদনদাদু এখন আর বেঁচে নেই।
দুদিন ধরে বাড়িতে পিঠে হতো, চারদিন খাওয়া হতো। একদিন ভাজা পিঠে, একদিন পুলি পিঠে। সংক্রান্তির আগেরদিন ভাজা, সেটা পরেরদিন সকালেও খাওয়া হতো, আর পয়লা হতো সেটা তার পরেরদিন সকাল অব্দি চলতো। ফলে চারটেদিন পিঠের গন্ধে আমার বাড়িতে টিকতে ইচ্ছে করতো না। আমি একেবারেই পিঠে খেতাম না, একটু আধটু দুধপুলি বা পাটিসাপটা ছাড়া।
পিঠের আগে চাল গুঁড়ো করার দিনগুলোয় বরং বেশি মজা পেতাম। ভেজাচালে তুলসীপাতা আর শুকনো লংকা দিয়ে চালটা ঢেকে নিয়ে যেতো হতো। তা নাহলে নাকি ভূত ধরতে পারে। ওই দিনেরবেলাতেও!
আমাদের বাড়িতে বহু আগে ঢেঁকি ছিলো। আমি সেটা দেখিনি। আমার ছোটবেলায় আমি তিনজনের বাড়িতে ঢেঁকি দেখেছি। তাদের সবার বাড়িতেই কুলগাছ ছিলো। আমি যেতাম কুল খাওয়ার লোভে। ওটা বাড়তি পাওনা। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে সাহায্য করার মতো ক্ষমতা আমার ছিলো না। সেটা মা লোক দিয়েই করিয়ে নিতো। নিজেও কখনো যেতো না। এখন আর ঢেঁকি নেই, সবাই মেশিনে গুঁড়ো চাল কিনে আনে। আমাদের একটাই অভিযোগ ছিলো মেজোমাদের পিঠেগুলো বেশি সাদা হয়। কাল মাকে জিজ্ঞেস করলাম মা পিঠে করবে? বললো - "পিঠে করবো, খাবার লোক কোথায়!"
আজ মাঘ মাসের পয়লা। উঠোন লক্ষ্মীর পুজো। ঠাকুমা নেই পেঁচার ডাক শোনার জন্য। আমরাও তিলে পাটালি খাবো না। তবুও কাল থেকে সময় কিন্তু একতিল একতিল করে সময় বাড়বেই।
khub bhalo laglo.aghrayan theke pousher swad gondho pelam.sudhu duto kotha : itur khadyo mane dupure seddho khabar ar raate luchir bibaran nei keno?; labour shabdatir bodole jon ba munish beshi bhalo shonato mone hoy.
ReplyDelete