স্মার্ট ফোনের কিছু কথা

বড় স্ক্রিন আর স্মার্ট ফোনের দৌলতে কে কাকে ফোন করে, কার কোন নামে ফোন আসে, তারা কেমন দেখতে,  একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়। আমি বাসে। যাদবপুর থানার সিগনাল। একজন বাইক চালক হেলমেট খুলে পকেট থেকে তড়িঘড়ি  ফোন বের করলেন। দেখলাম হোয়াটস অ্যাপে কল, বড় বড় অক্ষরে লেখা - Raj.  আবার দেখলাম আমার পাশে বসা মেয়েটা  Arindam এর  সঙ্গে চ্যাট করছে।



আজ মহিলা কামরায় এক দিদিমণি MA Airtel কে ফোন করলেন। খুব ফিসফিস করেই কথা বলছিলেন। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। তার পরেই হঠাৎ চিৎকার করে শুরু করলেন - “আরে ওই যে ওই যে, ২৭৮, নাকি ২৮০ কত একটা দাম না, ঠিক মনে নেই অমনই একটা কিছু হবে সেটা ভেঙেছে।”
ফোনের ওপার থেকে আবার এমন একটা কথা এলো তাতে উনি আবার চেঁচাতে বাধ্য হলেন।


“না মা, অমন বোলো না। কাকলির দোষ একদম দেবে না, সে আমার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সব করে, আর সে আমার এতো দিনের পুরোনো। তাকে রেখে আমি ভরসা করেই বেরোই। তার কোনো দোষ নেই। ও-ই ভেঙেছে। আরে বাচ্চাটা যখন ফ্লাস্কটা নিচ্ছে তখন তুই ধরবি না?! এখন বলছে ও ভেঙেছে।”


তখন আমি বুঝলাম দিদিমণির বাচ্চার আয়া একটা ফ্লাস্ক ভেঙেছে, দাম ২৮০ টাকা।


দিদিমণির আবার চিৎকার - “না না মা, একদম না, তুমি বাবাকে আজ ঘর থেকে বেরোতে দেবে না। আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। এই কদিন গরম ছিলো, আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। আর তাছাড়া তোমরা এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন? আমার চলে যাচ্ছে তো। ওই তো বাবা আমাকে ওই স্টিলের জার মতো একটা দিয়েছে না, সেটা দিয়ে চলছে। ওটা খুব সুন্দর। ওর আবার ঢাকনার কাছে ফ্লিপ বোতাম মতো একটা কি আছে। ওটা চাপলেই জল বেরোয়। ওটা কায়দার বলেই আমি ওই উড়োন চণ্ডীদের হাতে দিয়ে আসি না।”


“তোমার জামাইও বলছে ঠিক আছে, এবার রমা জল গরম করে নিক না কী এসে গেলো।”


“আসলে কী জানো তো মা - ওরা বসে বসে মাইনে পাচ্ছে তো, তিন হাজার টাকা পায়ের উপর পা তুলে পেয়ে যাচ্ছে তাই এতো কিছু গায়ে লাগছে না। তুমি বলো মা? আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে। যখন লেডি ব্রেবোর্নে পড়তাম। সেই পাঁচটা কুড়ির বাস ধরতে হতো। তুমি চেঁচাতে এমন অন্ধকারে যাওয়ার জন্যে। তারপর বলো! বি.এড করার সময়? বাবা এসে মোড়ের মাথায় খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমি খাবার নিয়ে পড়াতে চলে যেতাম। আর এরা? বসে বসে মাইনে পেয়ে এই অবস্থা! তারপর আবার কি বলছে জানো? বলেছে দাদা ভালো চাকরি পেয়ে গেলো, প্রিন্সিপ্যাল হয়ে গেলো, গাড়ি কিনবে। আর আমার মাইনে বাড়ালে না!”


মায়ের উত্তরে - কোথা থেকে জেনে গেছে কে জানে! জেনে গিয়ে বলছে - বললে না তো? আমি মনে মনে ভাবছি তোমাকে সব বলতে হবে! আর আমার গাড়ি কিনলে ড্রাইভার রাখতে হবে না যেন!! তার মাইনে দেওয়া থাকবে। আরে মাঝে মাঝে আবার কি বলে জানো - বলে আমার গায়ে গতরে ব্যথা। আমি বলি আমারো ব্যথা, তোমারটা মালুম করার মতো আমার অতো সময় নেই।


এবার ধীরে ধীরে গলা নরম করে - “মা শোনো, এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ওটায় চলে যাচ্ছে। আর ওটা তো বাবাই দিয়েছে।”


মায়ের উত্তরে - “শনিবার হয়ে যাবে তো কি হবে? এতো তাড়া নেই। আর না হলে এক কাজ কোরো বৃহস্পতিবার বিবেকান্দর জন্মদিনে ছুটি আছে। ওইদিন এসো। এই ঠাণ্ডায় বাবাকে আর সোনারপুর থেকে এতো দূর আসতে হবে না।”


সুর আরো নরম করে - “হ্যাঁ আমি জানি গো ভাই আসবে না, আমাকে Hike এ লিখেছে তো, আমি জানি। আমি ভাইকে খুব করে জপাচ্ছি - ভাই আয় না, আয় না, আয় না রে, মুনিয়াটার হাতে খড়ি দেবো। ওই সময় জন্মদিনও আছে। বললো - না রে দিদি হবে না। আসলে কী বলোতো - ও বাইরে যাবে তো, তাই আবার ওখান থেকে এসে, এখানে আসা ওর চাপ হয়ে যাবে। কিছু উত্তর হুঁ হুঁ করে দিয়ে - রাখছি মা, এবার নামবো।”


তিনি নেমে গেলেন।


উনি যখন ফোন অন করছিলেন তখন আমি ওনার বর ও মুনিয়ার ছবি দেখলাম। হোম স্ক্রিনে।


আর দিদিমণিকে দেখলাম, তাঁর ফোনে বাংলায় লেখা ছিলো - মা ভোডা।


এই দিদিমণি মেসে থাকেন। একটু অল্প বয়েস। বিয়ে হয়নি এখনো। ফোন করেই - “হ্যাঁ মা বেরিয়েছি। এই ট্রেনে উঠলাম। হ্যাঁ ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। আজ ডাল, মাছভাজা, করলা ভাজা আর একটা শাকের চচ্চড়ি ছিলো। হ্যাঁ আজ সবাই খুব খুশি। ভোলাদা এতো সকালে এতো কিছু রেঁধে দিয়েছে। সবার খুব আনন্দ হয়েছে।”


এই দিদিমণির কথা মহিলা কামরা নিয়ে প্রথম লেখায় আছে। সেখানে ইনি শাঁখা সিঁদুর নিয়ে অনেক গল্প করেছেন।


দুদিন আগেই দেখলাম এক যাত্রী কানে হেডফোন গুঁজতে খুব ব্যস্ত। তাঁর সহযাত্রী যখনই কিছু বলছেন, তখনই তিনি একটা কানের হেডফোন খুলে কথাটা শুনে উত্তর দিচ্ছিলেন। তাঁর সহযাত্রী আমার পাশেই বসে ছিলেন। একটু পরে আমার সামনের জায়গাটা ফাঁকা হতে উনি এসে বসে সহযাত্রীর সঙ্গে জমিয়ে গল্প শুরু করলেন। গল্প করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ায় হাতটা এলিয়ে ফোন কোলে পাতা। আমি দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখলাম তিনি একটা হিন্দি সিনেমা দেখছেন।


আগে ভাবছিলাম গান শুনছেন বুঝি।


এক দিদিমণি ফোন বের করেই স্লাইড করে টানলেন - Pool Car Driver.


“হ্যাঁ শুনুন সঞ্জয়দা আমি অদ্রিজার মা বলছি। আজ গাড়ির জানলাটা একটু বন্ধ রাখবেন। ওর খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। না হলে জানলা খোলা থাকলে পুরো হাওয়াটা লেগে আরো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, তারপর সেই ভুগতে হবে আমাকেই। বুঝতে পেরেছেন তো? ঠিক আছে রাখছি।”


এরকম Ma Airtel যেমন দেখেছি তেমনি BABA Bsnl ও।


“বাবা শোনো আজ আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে একবার ঘুরে যাবো। মাকে তুমি এখনই কিছু বোলো না। তাহলে একগাদা রান্না করে রাখবে, আর ওই অবেলায় ওগুলো খেতে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। আমি ওই তোমার সঙ্গে ওই কাজটা মিটিয়েই চলে আসবো।”


এরকমই এক গল্প অটোতেও।


এক প্রেমিক প্রেমিকা। কে ভাড়া দেবে তাই নিয়ে চলছিলো। তার মধ্যেই শুরু হলো ‘এখন ক্যাশ নিয়ে বড্ড ঝামেলা’। এই দু হাজারের খুচরো কেউ দিতে চাইছে না।


মেয়েটা বললো - “আমার মায়ের ফোনে একটু রিচার্জ করে দিতে হবে।”
সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা - “আরে রিচার্জ করতে হবে? দাঁড়া আমি করে দিচ্ছি।”
মেয়েটা - “মানে? তুই এজেন্সি নিয়েছিস নাকি?”
-- “আরে হ্যাঁ, তা আর বলছি কি, এমনি এমনি দেবো?” বলতে বলতেই ছেলেটা ফোন বের করলো।
মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠে - “কী? T24? মানে? তুই এই সিম use করিস নাকি?”
-- “আরে সে এক গল্প। মান্ধাতার আমলে Big Bazar যেতাম, তখন গছিয়েছিলো।”


আমারো মনে হলে একদম সত্যি, আমিও একটা পেয়েছিলাম বটে। সেটা ব্যবহার করতাম না। আমার শ্বশুরমশাই এখনও একটা ব্যবহার করেন। তাঁরও হাজারটা সিম। আমি ওটা Baba T24 নামেই সেভ করেছি।


কতরকমভাবে ফোন নম্বর সেভ করা থাকে একটু খেয়াল করলে বেশ মজাই লাগে। একদিন দেখলাম
Anindita NEW. আমি নিজেও এই ধরনের নামে সেভ করে থাকি। কোনো নাম দিয়ে 1st বা 2nd. কিন্তু সেদিন দেখলাম Arpita 3rd.


‘Purono College’, ‘MusaphirDa Office’, ‘Bente (বেঁটে) Kakali’, ‘Lambu’, ‘Amar munu’, এইসব কিছু নামে দেখেছি বটে, তবে ex BF বা ex GF নামে সেভ করা নাম এখনো আমার চোখে পড়েনি। হয়ত তাদের ফোন কথায় কথায় আসে না।  


এখন চারিদিকে জিও সিমের হাওয়া চলছে। সেই অর্পিতা কী সেটা নিয়ে এতোদিনে  Arpita 4th বা Amrita Jio হয়ে যায়নি? কে জানে! হয়েছে হয়তো।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত