কাদা

ছোটবেলা থেকেই কাদায় খুব ভয় পেতাম। গা ঘিনঘিন করতো। আজও করে। একটু বৃষ্টি হলেই আর বাড়ি থেকে বেরোতে ইচ্ছে করতো না। পুকুর পাড়ের কাদাকে এড়ানো অসম্ভব বলে। নিতান্ত দরকারে বেরোতে হলে নাকমুখ কুঁচকে কোনোরকমে যেতাম। পাড়ার চন্দনদা আমার যাওয়া দেখে বলতো -
"আ মলো অমন গোড়ালি উঁচু করে, আঙুল দিয়ে শহরের মেয়ের মতো হাঁটিস কেনো? কেমন থ্যাপাস থ্যাপাস করে পা ফেলে হাঁটবি তবেই না গ্রামের মেয়ে!"
হেসে চলে যেতাম।
বৃষ্টি ভালোবাসি খুব। স্বপ্ন ছিলো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমি স্কুলে যাবো, মাথায় ছাতা কিন্তু পায়ে চটি থাকতে হবে। পায়ে কাদা লাগা চলবে না। সম্ভব হয়নি। এখন লাল মোরাম আর কংক্রিটে মোড়া রাস্তা, একটু ঘুরপথে গিয়ে পুকুর পাড়ের কাদাও এড়ানো যায়। আমি স্কুলে পড়ি না।
এখন বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে জুতো পায়ে কলেজ যেতে পারি তবুও 'কাদা' ছিটকে গায়ে আসে। কাদার ধর্মই তাই। পাত্তা দিই না।
ছোটবেলায় কাদা দিয়ে বানানো পুতুল পাল্কি নিয়ে অনেক খেলেছি। একটাও নিজে বানাতাম না। মাখা আটা দিয়ে অনেক পুতুল বানিয়েছি। কিন্তু সেটা যত্ন করে ব্যাটারির বাক্সে ভরে শাড়ি-গয়না পরিয়ে রাখতে পারতাম না। ভেঙে যেতো। তাই কাদা দিয়ে যারা বানাতে পারতো তাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম কখন দুটো পুতুল বানিয়ে দেবে। একটা বউ আর একটা বর।
মাটির প্রদীপ বানিয়ে পৌষ মাসে অনেকে 'কুলকুলুতি'র ব্রত করতো আমি করতাম না। কাদা দিয়ে প্রদীপ বানাতে হয় বলে। একমাস রোজ সন্ধ্যেবেলা তিনটে করে প্রদীপ। ভাসানোর দিনে আরো কয়েকটা। তবে দেখতে খুব ভালোবাসতাম। যারা এই বার করতো তারা কাদা দিয়ে ছোট ছোট সুন্দর প্রদীপ বানিয়ে, রোদে শুকিয়ে নিতো। কার কতগুলো তৈরি হলো, কারটা বেশি সুন্দর দেখতে, তাই নিয়ে তারা বেশ প্রচ্ছন্ন আনন্দে মেতে উঠতো।
বাবানও একধরনের কাদা দিয়ে খেলে। Plasticine. আমি বলি রঙীন কাদা। তবে সে পুতুল, পাল্কি, প্রদীপ বানায় না। তার অনেক ছাঁচ আছে। হাঁস, খরগোশ, গাড়ি, ফুল বানায়। মায়ের জন্যে অপেক্ষা করে। মা বানিয়ে দেয় না বলে রাগ করে। কিন্তু মা এই কাদাতেও হাত দিতে পারে না। হাতে এলার্জি হয়।
আমার মা'ও আমাকে বানিয়ে দিতো না। মামাবাড়ি থেকে ফেরার সময় চক্করপুরের মেলা থেকে পোড়া মাটির পুতুল আর পাল্কি কিনে এনে দিতো।
শরীর বা মন খারাপ হলেই আমরা ছোটবেলাকে আঁকড়ে ধরি। স্টিফ নেক নিয়ে বই পড়তে, লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তাই বোধহয় আজ ছোটবেলায় ফিরে গেলাম।মনে হচ্ছে এখন একটু কাদা পেলে, আমি নিজের পুতুল নিজেই বানিয়ে নেবো। পুতুল খেলার একটা ঘর, যেমন ছিলো আমার সেই ওপরের মাঝের ঘরটা।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত