মহিলা কামরা - ৪
ফেরার সময় দেখি মহিলা কামরার ছবিটা বেশ অন্যরকম থাকে। এমনকি দুপুরের ট্রেন একরকম হয়, বিকেলের ট্রেন আর একরকম।
দুপুরের ট্রেন সাধারণত খুব ফাঁকা হয়। সবাই মোটামুটি হাত পা ছড়িয়ে, অন্য সিটে দু-পা তুলে যায়, কেউবা শুয়েও। বিশেষ করে যারা ঠিকে কাজ করে বা বাজার থেকে ফেরে তারা। কোনো কোনো মাসি তো বাজার ফেরত বাকি সবজিগুলো গেটের ধারে ছড়িয়ে বিক্রি করতে বসে যায়। শুকনো করলা, পটল, বীনস, কাঁচালঙ্কা, শাকও থাকে। তখন তারা পারলে মোটামুটি সবগুলোই দশ টাকাতে দিয়ে দেয়।
মোসাম্বিওলা পিন্টু তখন গেটের মুখে ফাঁকা জায়গায় বসে তার লেবুর বস্তা থেকে লেবুগুলো একটা একটা করে নিয়ে গামছা দিয়ে মুছে মুছে ঝুড়িতে রাখে।
এইসময় বাদামচাক, ওয়াফেল, টক-ঝাল, লেবু, আদা, আনারস লজেন্সওলা সবাইকেই ট্রেনে দেখি। কিন্তু এরা সবাই অন্য, দু - চারজন বাদ দিলে আর কাউকে সকালে যাবার ট্রেনে দেখা যায় না।
একজন ফেরিওলা আছে উঠেই প্রচন্ড নাকি সুরে শুরু করে দেয় — “এই কাজু না, কিসমি না, আমসত্ব”। তার ঝুড়িতে থাকে ছোট ছোট কাজু, কিসমিস, আর আমসত্বের প্যাকেট। পাঁচ আর দশ টাকার। আর একদম ছোট ছোট আমসত্বের পুরিয়া এক টাকা করে। কিন্তু সে কেনো যে — “কাজু না, কিসমি না” বলে আশ্বস্ত করতে চায় সেটা বুঝতে পারি না।
ফেরিওয়ালাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো। শুধু হাসি বিনিময় নয়। একে অন্যকে নিজেদের জিনিস দিয়েও এরা বন্ধুত্ব বজায় রাখে। বিশেষ করে লজেন্সওলা সবাইকে লজেন্স দেয়। তারা নিজেদের মধ্যে সুখ দুঃখের গল্প, কাজের কথা সবই আলোচনা করে। একদিন লজেন্সওলা বললো কোন দুই ভাই নতুন এসেছে এই লাইনে, তাদের থেকে এদের পাণ্ডা হাজার টাকা নিয়েছে মদ খেতে। তারা খুব মনমরা হয়ে আছে। এদের নিজেদের “মিটিং”ও হয়। একদিন তপনদা এক ক্লিপওলাকে জিজ্ঞেস করলো — “কাল মিটিংটা হয়নি তো?” সে উত্তর দিলো — “না হয়নি।” তপনদা বললো — “ভালো হয়েছে, আমি আসতে পারতাম না।”
দুপুরের ফাঁকা ট্রেন এতোই ফাঁকা হয় যে কখনো কখনো ছেলেদেরও উঠতে দেখা যায়। একদিন আমি দুজন ষণ্ডামার্কা লোককে দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। তাদের মধ্যে একজন আবার জামার ওপরের দিকের বোতামগুলো খুলে রেখেছিলো। তার বুকের কাছ থেকে পেট অব্দি আমি কাটা দাগ দেখেছিলাম। সেদিন মোটামুটি প্রাণ হাতে করে বসেছিলাম। তার কদিন আগেই ওই ট্রেনে ছিনতাই হয়েছে। এমনকি পেয়ারাওলা রাজকুমারকেও ছুরি দেখিয়ে সব কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে।
অন্য আর একদিন মাঝ বয়সী দুটো লোক দেখলাম। তপনদা এসে ফিসফিস করে বললো এখন খুব ছিনতাই হচ্ছে, তাই সিভিল ড্রেসে পুলিশ থাকছে। যেন প্রাণ আসলো ধড়ে। আমার ফোনটা হারিয়ে যাওয়ার দিন আমি বালিগঞ্জ রেল থানায় বলেছিলাম, “এতো ছিনতাই হচ্ছে, কোনো নিরাপত্তা নেই, খুব মুশকিল তো।” ওঁরা আমাকে পুলিশের সংখ্যার হিসেব দিয়ে বলেছিলেন — “অর্ধেকের বেশি পুলিশ মন্ত্রীদের গার্ড দিতেই চলে যায়। আমরা যদি একদিন স্ট্রাইক করি কতজন মন্ত্রীর মাথা পড়ে যাবে জানেন? জানেন না। জনতা এতোটাই ক্ষেপে আছে যে ওদের সিকিওরিটি দিতেই আমাদের লোক শেষ হয়ে যায়। তাহলে কতগুলো ট্রেনে আমরা লোক দেবো?”
কি আর করা। এমন অকাট্য যুক্তি শুনে চুপচাপ “হুম” বলে ঘাড় নেড়েছিলাম।
দুপুরের ফাঁকা ট্রেনে মাঝে মাঝে প্রেমিক প্রেমিকাদেরও দেখা যায়। একবার দেখেছিলাম — মেয়েটা যতটা উৎকট সেজেছিলো ছেলেটাও ঠিক ততটাই। সোনালি চুলের স্পাইক কাট, তার ওপরে জেল-ফেল লাগিয়ে বেশ দেখার মতো। চুলটা ঠিক সোনালি নয়, সবুজ ঘাসকে ঢেকে রাখলে তার ক্লোরোফিল চলে গিয়ে যেমন জ্বলে যায় ঠিক তেমন। মেয়েটাও পাল্লা দিয়ে ঝিকঝাক ড্রেসের সঙ্গে চড়া মেকাপ আর লিপস্টিকে নিজেকে এমন সাজিয়ে ছিলো বেশিক্ষণ তার দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। তারা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো তাতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভবও ছিলো না।
——
দুপুর আর বিকেলের ফেরার ট্রেনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। তার ওপর যদি জেনারেল বগি হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। তবে মহিলা কামরায় ভিড় একটু কম থাকে।
ফেরার সময় ক্লান্ত দিদিমণিরা আর তখন চেঁচামেচি করেন না। নিজেদের গ্রুপ উঠলে আলাদা কথা। না হলে সবাই ঝিমুনিকে আঁকড়ে চুপ থাকতেই ভালোবাসেন। আবার কেউবা হাই তুলে তুলেই কাটিয়ে দেন।
তবে ওই সময় চেঁচামেচি করে গল্প করে স্কুল ফেরত নাইন থেকে টুয়েলভের মেয়েরা। তাদের ফিজিক্স ভালো লাগে, না কেমিস্ট্রি, ম্যাথ নাকি বায়োলজি — এইসব চলে। একদিন দুটো মেয়ের গল্প শুনলাম — “জানিস তো নতুন একজন বায়োলজি টিচার এসেছেন? দারুণ দেখতে কিন্তু।”
— “হ্যাঁ হেব্বি হ্যান্ডসাম!”
— “দেখেছিস?”
— “হ্যাঁ।”
— “আরে আমাদের সঞ্চারী তো পুরো ফি--দা। তার কোনো দরকার থাক বা না থাক, সে পারলেই স্যারের কাছে চলে যায়।”
— “সে কি রে? স্যার কিছু বলেন না?”
— “না। ইনি মানুষটাও খুব ভালো। যতবার যায় ততবারই হেল্প করেন।”
— “তাহলে ভালো। আরে আমাদের স্কুলে সবাই প্রায় ভালো। শুধু ঐ শিঁটকে মার্কা ম্যাথের টিচারটাকে আমার একদম সহ্য হয় না। ওই আগে ভূগোলেরটা যেমন ছিলো, ঠিক তেমন। বাব্বা! তিনি বিদেয় হয়েছেন বেঁচেছি।”
দিদিমণিদের মধ্যে যাঁরা ক্লান্ত হন না তাঁরা শুরু করেন তাঁদের শাশুড়ি মা নিয়ে। বেশ জোর গলাতেই। অথবা হয়তো বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির লোকের কথাই মনে পড়ে। একদিন এক দিদিমণি স্কুল সেরে বিয়েবাড়ি যাচ্ছিলেন। হাতে ছিলো গিফটের প্যাকেট আর বিশাল বড় একটা ফুলের বোকে। তিনি বলতে শুরু করলেন — “আমার আবার বিশাল জ্বালা। সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে হবে। না হলেই তো শাশুড়ি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। তাই একেবারেই স্কুল থেকে চলে যাচ্ছি। গিয়ে একবার দেখা করে গিফটটা দিয়ে চলে আসবো।” শাশুড়ি সম্পর্কে আরও বললেন — “মহিলা এই গিফট কেনা নিয়েও অনেক ঝামেলা করেছে। মহিলার গুণের শেষ নেই। এতো ছুঁচিবাই কি আর বলবো। সারাদিন শুধু এঁটো-সকরি জিনিসের বিচার করে যায়। আর এদিকে তার বাথরুমে ঢুকলে দেখা যায় কাঁড়ি কাঁড়ি বাসি, পরা জামা-কাপড় ঝুলছে। সেদিকে ছুঁই ছুঁই নেই। এদিকে ভাত ফ্রিজে রাখতে দেয় না। যত্তসব। আনহাইজেনিক জিনিসে নজর নেই। শুধু ভাত, সকরি এইসব নিয়ে বাতিকগ্রস্ত। আর কি করে বৌয়ের পেছনে লাগা যায়।”
অন্য দিদিমণি শুরু করলেন — “আরে আমারটা তো আর এক। বাড়ি ফিরে শান্তিতে একটু টিভি দেখতে পাবো? এসে অমনি জুড়ে দেবে, এটা হয়নি, ওটা হয়নি।” বলেই একটা গল্প বললেন — “কাল কী হয়েছে জানিস - বাবু টিউশন থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে একবার টিভি দেখতে বসেছে। ব্যাস! তাকে তো পুরো পাগল করে দিচ্ছিলো - ‘তোর বাবা এলে এই বলবো, সেই বলবো’। আর বাবু ঘুরে খুব দিয়েছে। আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছে। তুই ভাবতো ক্লাস এইটের একটা ছেলে তার পিছনে যদি অমন অকারণ খ্যাচ খ্যাচ করে তাহলে সে রেগে যাবে না? কাল বাবু ঠিক করেছে। খুব ভালো হয়েছে। মাঝে মাঝে অমন বলা দরকার। নিজে গাদা গুচ্ছের সিরিয়াল দেখবে তাতে দোষ নেই, আর আমি বা বাবু একবার টিভি দেখতে বসলেই তার মাথায় বাজ পড়ে যায়। কাল বর ফিরতেই আমি বলেছি - ‘আমাদের শোওয়ার ঘরের জন্যে এবার একটা কেনা দরকার’।”
— “শুনে কী বললো?”
— “কী আর বলবে? চুপ করে ছিলো। জানে তো মা কেমন।”
অন্য দুই দিদিমণি শুরু করলেন — “কাল ফিরে আমি বধূ বরণটা দেখতে পাইনি জানিস।”
— “ও। আমি জাস্ট ঢুকেছি আর শুরু হলো। ফ্রেশ না হয়েই আগে বসে গেছিলাম।”
— “কাল কী দেখালো?”
— “সেই একই জিনিস। ঝিলমিল আর তার মা শয়তানি করে যাচ্ছে। কনক মুখ বুজে সহ্য করছে।”
— “শেষ অব্দি কি হবে কে জানে? ওটা তো হিন্দি সিরিয়াল থেকে নেওয়া।”
— “হ্যাঁ, তবে হিন্দিটায় শুনেছি কনক আর ঝিলমিলের বাচ্চা হবে। ঝিলমিলের মেয়েরা ভালো, আর কনকের ছেলে খুব দুষ্টু হবে। ঠিক এটার উল্টো। আর দেখা যাবে কনকের মা ফিরে আসবে। বাংলাটায় শেষমেস কী হবে কে জানে! সিরিয়ালগুলো এতো অনন্তকাল ধরে চলে যে তার আর মান থাকে না। টেনে টেনে এটা -সেটা ঢোকায় তখন আর দেখতে ভালো লাগে না। ওরা শুরুটা ভালো করে। কিছুদিন অব্দি ঠিক থাকে তারপর গাঁজাখুরি শুরু করে দেয়।”
তারপর তাঁরা অন্যান্য সিরিয়ালের কোনটার কত পর্ব চলছে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
বৌমাদের যেমন শাশুড়িমা নিয়ে অভিযোগ থাকে, শাশুড়িমাদেরও তেমনি বৌমা নিয়ে। অন্য এক মাঝ বয়সী দিদিমণি শুরু করলেন তাঁর বৌমা নিয়ে। এই দিদিমণি তাঁর বৌমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন কিন্তু বৌমা তেমন সুবিধের না। তিনি বললেন — “আমি কখনো তাকে দুইদুই করি না। আমি তাকে বলেছি আমার মেয়ে যেমন তুইও তেমন। আমি আজ অব্দি কিছু কিনলে দুজনের জন্যেই সমান জিনিস কিনি। তবুও তার মনে হয় আমি মেয়েরটাই ভালো কিনি। আমি তাকে আগে বেছে নিতে বলি তবুও। আর সে নিজে যা কেনে বা ছেলে যেগুলো কিনে দেয় সেগুলো সব আগেই আলমারিতে ভরে দেয়, দেখায় না অব্দি।”
— “বৌমা রান্না করে?”
— “রান্না? এই যে ফিরবো একগ্লাস জল অব্দি মুখের কাছে ধরে না। আমি বলে দিয়েছি। আমি যতদিন শক্ত-সামর্থ্য থাকবো ততদিন আমি কারো আশা করিনা। তারপর তো আমার পেনশন থাকবেই।”
শুরুতে কাউকেই আমি চিনতাম না। আজ অনেককে চিনেছি। তাদের নাম জেনেছি। সবাই আমারও মুখ চিনেছে। হয়তো বা কেউ কেউ নামও জেনে গেছে এতোদিনে। অনেকের হাঁড়ির খবরও আমি জেনেছি। যে সমস্ত দিদিমণিরা ফেরিওলাদের বলেন আমরা ষাট বছর বয়েস অব্দি এই ট্রেনেই যাবো, কোনো চিন্তা নেই, ট্রেনের গতির সঙ্গে সমান তালে এমনি ভাবেই ছুটবে তাদের জীবন। আরো নতুন মুখ জুটবে। যাঁরা রিটায়ার করবেন তাঁদের জন্যে এপথ বন্ধ হবে। আমার জীবনও যদি মোড় নেয় অন্য পথের বাঁকে, তখনো লিখবো। অন্য কথা। অন্যদের কথা। শুধু পাল্টে যাবে গল্প।
Comments
Post a Comment