মহিলা কামরা - ২
- “বাসন মাজা — স্কচ ব্রাইটটা পাবেন — চুউউলের ক্লিপ — সেফটিপিন —” টান দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে হাজির হয়ে গেলো স্বপনদা।
- সঙ্গে সঙ্গেই এক মহিলা ডাকলেন — “দাদা সেফটিপিন দেবেন এক পাতা।”
- “কোনটা? বড় না ছোট পাতা?”
- “ছোটটাই দিন। এই ক্লিপগুলো কত করে?” ছোট সাইজের একটা ক্লিপ দেখিয়ে — “পাঁচ টাকা?”
- “পাঁচ টাকা? পাঁচ টাকায় আজকাল আর ক্লিপ হয় না দিদি। এটা দশ, এটা পনেরো আর এটা কুড়ি” — বলেই
স্বপনদা তিন-সাইজের তিনরকম ক্লিপ দেখিয়ে দিলো।
এর মধ্যেই অন্যদিক থেকে আর একজন - “পেয়ারা! এই ভালো ভালো ডাঁশা পেয়ারা! পাঁচ টাকা পিস। জোড়া দশ। পাঁচটা কুড়ি। দেবো নাকি দিদি?”
এর থেকে অনেকেই পেয়ারা কেনে। তবে রাজকুমার যতটা জনপ্রিয় এ ততটা নয়। রাজকুমার উঠলে সবাই, এমনকি দিদিমণিরাও, রাজকুমার রাজকুমার বলে এমন ডাকাডাকি ফেলে দেয়, যে সে পুরো পাগল হয়ে যায়।
তার চোখ-মুখ দেখে মনে হয়, কোনদিকে আগে গেলে ভালো হয় সেটা যেন সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না।
একে দেখে কেউ তেমন একটা ডাকাডাকি করে না। তবে মাঝে মধ্যে আমি এর কাছ থেকে পেয়ারা কিনেছি, ভালোই দেয়। আমার এক কলিগ জানতে চেয়েছিলো — “এই পেয়ারাওলা কেমন পেয়ারা দেয় রে? রাজকুমার তো খুব ভালো দেয় শুনেছি।” মুচকি হেসে বলেছিলো — “যদিও তার থেকেও কিনিনি কখনো।”
বলেছিলাম — “ভালো, খারাপ নয়।”
এ মোটেই নতুন নয়। আমি তো প্রায় রোজই দেখি। শুধু তাই নয়, বহুবার এর পেয়ারার ঝুড়ি খালি হয়ে যেতেও দেখেছি। তবুও ‘রাজকুমার’ বলে কথা।
এদিনও জিজ্ঞেস করলো — “দিদিমণি, পেয়ারা?” বললাম — “না। ফেরার সময় যদি থাকেন নেবো।” সে একগাল হেসে বললো — “এখন দেবো না?” আমি আবার বললাম — “না।”
একদিন রাজকুমার মহিলা কামরায় উঠেই খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে না দেখে পরের স্টেশনে নেমে যেতে যাচ্ছিলো গেটের মুখে ভিড় থাকায় তার নামা হলো না। সে গজগজ করতে করতে আবার কামরার ভিতরে অন্যদিকটায় ঢুকলো। এক চেনা দিদিমণিকে দেখে ডাকলো — “কি দিদিমণি পেয়ারা দেবো?”
দিদিমণিও সুযোগ বুঝে — “এখন কেনো? হ্যাঁ?! এতোক্ষণ তো আমাদের পাত্তাই দিচ্ছিলে না, নেমে চলে যাচ্ছিলে। নামতে পারলে না দেখে এখন দিদিমণিকে মনে পড়লো?”
রাজকুমার লজ্জায় রাঙা হয়ে এক মুখ হেসে বললো — “ছি! দিদিমণি এমন বলবেন না। আপনাদের জন্যই তো আসি। আপনাদের না দিয়ে কখনো গেছি? বলুন কতটা দেবো?”
দিদিমণি — “আর পারবো নিতে? এক্ষুণি তো নামতে হবে। সময় হবে না গো” বলতে বলতেই নেমে গেলেন।
রাজকুমারের বিক্রি তখন জমে উঠেছে, তাই কামরার ভেতর থেকেই হাঁক দিলো — “দিদিমণি নেবেন কিনা বলুন? তাহলে আমিও নামছি।” দিদিমণি “না আজ থাক, তোমাকে নামতে হবে না”, বলে হাঁটা দিলেন।
“ভাজাআআআ বাআদাআম? চিঁড়েভাজাআআ, ডালমুট, ঝুরিভাজা। সবুজ- মটর দুই,পাঁচ। বড় চিপস দশ। ডালের ভুজিয়াআ” — সুর করে বলতে বলতে খুব বয়স্ক এক দাদু ওঠেন। বয়স আন্দাজ করতে পারি না, তবে টাকমাথা, দাঁত মাত্র আর দু একটা আছে, কোমরটাও প্রায় পড়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, অল্প ঝুঁকে দাঁড়ান। একহাতে থাকে অনেক প্যাকেট আর অন্যহাতে একটা কাঁচি।
দাদুর বয়স এবং কষ্ট দেখে অনেকেই আহা-উহু করে। যারা তা করে, তারা কিন্তু দাদুর থেকে কেনে না। একমাত্র কচিকাঁচাগুলো খুব বায়না করলে বা কোনো দিদিমণি নেহাত খিদে সহ্য করতে না পারলে তবেই দাদুর ভাগ্য খোলে। দাদুর বয়সের ভার আর শরীরের কষ্ট তাঁর হাসিকে মলিন করেনি। ফোকলা দাঁতে বেশ সুন্দর হাসি দিয়ে সুর করে হাঁকতে হাঁকতে কামরার এদিক থেকে ওদিকে চলে যান। কাউকে কখনো কেনার জন্য জোর করেন না।
এদিকে তপনদা আমাকে জোর করতেই থাকে। আমি তাকে প্রতিদিন বুঝিয়েও পারিনা যে আমি হজমিগুলি, পুদিনাগুলি, ভাজা জোয়ান কিচ্ছু খাই না। ঠিক এসে হাসি হাসি মুখে আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করতে থাকে। “আনারদানাটা খেয়ে দেখুন।” একটাই আশা, অনেক বোঝানোর পর যদি কোনোদিন ভুল করেও একটা প্যাকেট কেনে।
একজন মাসিও আছে যে নানাধরণের চিপস বেচে। প্রচণ্ড খড়খড়ে গলায় চেঁচাতে শুরু করে দেয় — “এই চালের চিপস, সাবুর চিপস, মশালা চিপস, প্লেন চিপস ছোট পাঁচ, বড় দশ।” বলার ফাঁকে ফাঁকে চেনা প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে গল্পও জুড়ে দেয়। একদিন এক খুব বুড়ি মহিলার পিছনে লাগলো দেখলাম। “এই বুড়ি তোর জলের বোতলটা দিবি? দেনা? একটু খাই। ফ্রিজের জল এনেছিস নাকি? দেনা গো একটু গলাটা ঠাণ্ডা করি।” সেই মহিলা খুব বিরক্ত হয়ে মুখ বেঁকিয়ে ট্রেনের বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন।
মাসির জীবন খুব সুখের নয়। মাসির বর মাসিকে ছেড়ে চলে গেছে। স্টেশনে বসে একদিন মাসি এক শশা বিক্রেতা মহিলাকে গল্পটা বলছিলো — “মুখপোড়া এখন কোন চুলোয় আছে কে জানে? আদৌ বেঁচে কি মরে তাও জানিনা। যখন ছেড়ে চলে গেলো তখন কম কষ্ট ভোগ করেচি মা। ওই ছোট ছেলে নিয়ে কম নাকাল হইনি।”
অন্য মহিলা — “ক্যানো মাসি? গেলো ক্যানো?”
— “কি জানি মা, কি বিকার হয়েছিলো। গেচে যখন দুঃখ হয়েচে। কিন্তু তার আগে আমাকে কম কষ্ট দেয়নি মাগো! কি বলবো রোজ মদ খেয়ে এসে অত্যাচার কোত্তো। মুখপোড়া গ্যাচে বেঁচেচি। আজ দুটো পয়সার মুখ দেখতে পাচ্চি।”
— “মেসো আবার বিয়ে করেচে নাকি মাসি?”
— “কি করে জানবো আমি? বলচি না তার কুনো খবরই আমার জানা নেই মা।”
বলতে বলতেই সেদিন ট্রেন এসে গেছিলো, বাকি গল্প আর শোনা হয়নি।
মেয়েদের চুলের ক্লাচার, হার, কানের দুল, বালা, ব্যাক ক্লিপ, টিপ নানান গয়না নিয়ে যারা ওঠে তাদের মধ্যেও কারো রেপুটেশন বেশি, কারো কম। এখানেও আছে এক রাজকুমার, সাকির, সাহেব এবং মাঝবয়েসি একজন “কাকু”। কাকুর থেকে আমি দুবার ক্লিপ কিনেছিলাম। কাকুর একটা হাত চাপা দেওয়া থাকতো। পরে খেয়াল করে বুঝেছি যে একটা হাত নেই।
ক্লিপওয়ালা রাজকুমারদাও খুব ফেমাস। অনেককেই বলতে শুনি “আমি রাজকুমারের কাছে কিনি”। তার কাছে দিদিমণিদের অনেক আবদার দেখেছি। “তোমাকে তো বললাম রাজকুমারদা, এই ঝুমকোটা নয়, অন্য ধরণটা এনে দিতে। সেই জয়পুরী স্টাইলটা।”
রাজকুমারদা আশ্বাস দেয় — “দেবো দেবো।”
— “ঠিক আছে। বলো আজ এটার জন্য কত দেবো?”
— “একশো ষাট।”
— “কী? একশোওওও ষাআআট!” আকাশ থেকে পড়েন দিদিমণি। “তুমি তো দিনেরবালাতেই গলায় ছুরি বসিয়ে কাটছো রাজকুমারদা। নাহ! আর তোমার থেকে এতো জিনিস নেওয়া যাবে না” — বলে দেড়শো টাকা বের করে হাতে দিতে গেলে রাজকুমারদা কিছুতেই রাজি হয় না। বলে “এতো টাকা লাভ থাকেনা আমাদের দিদিমণি।”
দিদিমণিও আর দশ টাকা বের করতে চান না।
শেষে রাজকুমারদা বলে — “ঠিক আছে আর পাঁচটা টাকা দিন।”
দিদিমণি ভীষণ পছন্দের দুলটা হাতছাড়া করতে চাননা বলেই সেদিন ঠোঁট উল্টে ব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকা বের করে দিয়েছিলেন।
এক মহিলাও তার বৌমার জন্য কিনলেন — “রাজকুমার ঝুমকোর টপটা যেন গোল হয়, লম্বা নয়।”
— “আচ্ছা ঠিক আছে, এটা দেখুন তো মাসিমা।”
“মাসিমা” অনেক দেখে লম্বাটাই কিন্তু নিলেন। তাঁর সঙ্গী বারবার বলছিলো — “তুমি তো গোল চাইছো? তাহলে লম্বা নিচ্ছো কেন? গোলটা তো ভালোই দেখতে।” তবুও মাসিমার লম্বা পছন্দ হলো। বললো — “নিয়ে যাই, পছন্দ হলে পরবে, না হলে আবার বদলে নিয়ে যাবো।” সঙ্গী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, “একি? এটা তোমার নয়?”
মাসিমা হাউমাউ করে উঠলেন — “মরণ! আমি এসব পরি এই বুড়ো বয়সে? দেখ আমি কানে যেটা পরে আছি” — কান দেখিয়ে — “এটা পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিচ্ছু হয়নি। বহুলোক আমাকে জিজ্ঞেস করেছে এটা সোনার? আমি ইয়ার্কি করে বলেছি হ্যাঁ পাঁচ টাকার সোনা।”
তাকিয়ে দেখলাম কানের টপটা সোনার মনে না হলেও, খারাপ নয়। রঙ-টঙ ঠিকই আছে, চটে যায়নি। সেই মাসিমা তার সঙ্গীকে বলছিলেন — “আমাকে একটা কাজ খুঁজে দেনা, একটা টাইম ফাঁকা আছে।” তারপর তিনি কোথায় কার বাড়িতে কি কাজ করেন তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হলো।
এই রাজকুমারদা, সাকির সবার কাছেই জিনিস অর্ডার দেওয়া যায়। একদিন এক দিদিমণি সাকিরের কাছে অর্ডার দিলেন তাঁর মেয়ের জন্য সাদা পাথর বসানো একটা গোল টাইপের বাউটি। সেই বাউটি সেদিন সাকিরের কাছে ছিলো। সেটা দেখে পছন্দ হতে যেই দিদিমণি কিনতে গেলেন, দেখা গেলো বাউটিটায় একটা তারের খোঁচা এমনভাবে বেরিয়ে, চোখে-মুখে লাগলে বিপদ হতে পারে। দিদিমণি তাই সেটা না নিয়ে নতুন বাউটির অর্ডার দিলেন। আর সাকির সেটাকে অনেক এদিক-সেদিক বাঁকিয়ে, তারটা মুড়ে বেচার চেষ্টা করলো। পারলো না।
তারপর থেকে ওই দিদিমণি সাকিরকে যখনই দেখতে পেতেন, জিজ্ঞেস করতেন — “কি গো? এনেছো?”
— “কী বলুন তো?”
— “আমার মেয়ের বাউটিটা?”
সাকির এক হাত জিভ বের করে বলতো — “এই দেখেচেন একদম খেয়াল ছিলো না। পরের সোমবার ঠিক এনে দেবো।”
সোমবারে দিদিমণি বললেন — “আজ এনেছো? নাকি আবার ভুলে গেছো?”
— “সরি দিদিমণি, সত্যিই ভুলে গেচি।”
— “পরের সপ্তাহে কিন্তু অবশ্যই এনে দিও। তোমাকে বললাম না একটা বিয়েবাড়ি আছে।”
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ চলার পর অবশেষে দিদিমণি কিন্তু সেই সাদা পাথর বসানো সুন্দর বাউটি পেয়েছেন।
সাকিরকে কোনোদিন আলাদা করে আমার চোখে পড়তো না, যদি না সে যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতো। যেদিন আমার ফোন চুরি গেছিলো সেদিন আমি ট্রেনের মধ্যে হৈচৈ চেঁচামেচি না করে চুপচাপ ‘থ' হয়ে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা মেয়ের থেকে ফোন চেয়ে আমার বরকে ঘটনাটা বলেছিলাম। আর একজন হকার আমার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো বলে আমি তাকে বিড়বিড় করে বলেছিলাম — “আমার ফোনটা চুরি গেছে।” সে শুনতে পেয়েছিলো কিনা জানি না। আমার মনে হয়েছিলো ও বুঝি আমার অবস্থা বুঝেছে, তাই বলেছিলাম। তবে পরে ওই হকারকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। মনে হয়েছিল সে আসলে ফ্যালফ্যাল করে নয়, যেন চোরচোর করে তাকিয়ে ছিলো। আমি বলার পরেই পরের স্টেশনে নেমে চলে গেছিলো। তাকে ওই ট্রেনে রোজ দেখতাম না, মাঝে মধ্যে দেখতাম। কোমরে কলসি নেওয়ার মতো করে একটা বড় বোয়েম নিয়ে ঘোরে। তাতে থাকে নানা রঙয়ের টক-ঝাল লেবু লজেন্স, আদা, জেলি, লিচু লজেন্স। আর আমার দিকে তাকানোটা সেই একইরকম।
পরেরদিন আবার ওই কামরায় উঠেছিলাম। সাকির সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে এসে বলেছিলো — “কি ম্যাডাম, আগেরদিন আপনার ফোন চুরি গেলো আর আপনি আমাদের একটুও বললেন না? আপনি যখন নেমে গেলেন তখন এক মহিলা বললো। আপনি তো আমাদের একটু বলে দেখতে পারতেন। আপনি তা না করে চুপচাপ বসে রইলেন! আমরা যারা থাকবো তাদেরকেই বলবেন। এরকম আমরা অনেক চোর ধরে দিয়েছি। ওদের আমরা চিনি। দেখলেই চিনতে পারি। এই তো সেদিনই একটা ধরে পাবলিকের হাতে দিয়ে দিলাম। পাবলিক পেটাতে পেটাতে নিয়ে গেলো।”
তার কথা শেষ হতে বিমর্ষ হয়ে বলেছিলাম — “হুম! আমার তো জানা ছিলো না।”
তারপরেই শুরু করেছিলো — “দিদিমণি আপনি কোথায় থাকেন? কোথায় পড়ান?”
শুনে বলেছিলো — “তাহলে অনেকটা আসতে হয় তো আপনাকে।”
— “এই পাবলিক ‘টান্সপোটে’ যাতাত করেন, এতো দামি দামি ফোন ইউস করেন কেনো? একদম করবেন না। কথা বলার জন্যে যেটুকু না হলে নয়, এই একদম এরকম” — পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে দেখিয়ে — “সেরকমই কিনবেন।”
— “যাগগে! থানায় ডায়রি করেচেন তো?” বললাম “হ্যাঁ।” জানতে চেয়েছিলো থানায় আমাকে কি বলেছে। সব শুনে বলেছিলো — “থানায় তো অমন হাজার হাজার ডায়রি হয়। তারা চাইলেই ধরতে পারে।” পুলিশদের উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বলেছিলো “কাজ করলে তবে তো ধরবে। দেখুন আপনারটা কি হয়। চলি ম্যাডাম” বলে অন্যদিকে চলে গেছিলো।
একদিন এক দিদিমণি ট্রেনে উঠেই তার মোবাইল ফোনটা বের করে বসেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এক রুমালওলা চেঁচিয়ে তার রুমাল বিক্রির সুরেই বলতে লাগলো — “দিদিমণি ব্যাগে ফোন ঢোকান, একদম হাতে রাখবেন না। এখন খুব চুরি হচ্চে। জানলা দিয়ে পুরো হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দৌড় দিচ্চে।” গায়ে পড়ে জ্ঞান দেওয়াতে বিরক্ত হয়ে দিদিমণি চোখ কপালে তুলে এমন করে তাকালেন, তাই দেখে আমার কলিগ বলতে শুরু করলো “হ্যাঁ গো একদম সত্যি কথা। ঠিকই বলেছে ও।” তখন আমিও বললাম — “হ্যাঁ আমি তো জানি। আমারটাও তো গেছে। তবে ব্যাগ থেকে।”
এরকম জিনিস নিয়ে আরো অনেকেই উঠলেও সবাই ফেমাস হয়ে উঠতে পারেনি। আরো এক মাসি আছে। বাচ্ছাদের নজরকাঠি, হাতের নোয়া, কালো কাড়, টাইগারবাম, আইকার্ডের কভার, রেশন কার্ডের কভার, পাসপোর্ট এর কভার বেচেন। সেই মাসির বিক্রির মাত্রা খুবই কম। তার মুখে কখনোই হাসি দেখিনি। সবসময় একটা ব্যাজার মুখ করে জিনিস বিক্রি করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সারাদিন ঘুরে মাসি কেমন আয় করে? চলে যায় নিশ্চয়ই।
পাশে বসা কোনো প্যাসেঞ্জারের ফোনালাপ থেকে তার মনের অবস্থা, পারিপার্শ্বিক দিকও বোঝা যায়। সেদিন শুনলাম এক মহিলা ফোনে বলছেন — “হ্যাঁ? হ্যালো! ভালো আছো?”
— “হ্যাঁ বেরিয়েছি। হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো যাচ্ছি ট্রেনে আছি। তোমাদের সব ভালো তো?”
— “জানো? অমুক এখন চাকরি পেয়ে গেছে। রাইটার্সে বসছে।”
— “আরে বুঝতে পারছো না? ওই তো অমুক। ক্লাস এইটও পাশ করেনি। জাস্ট ভিতরে ভিতরে সোর্স করে পেয়ে গেলো।”
— “এতোদিন তো তারাতলায় একটা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতো। হ্যাঁ হ্যাঁ। কপাল। বুঝলে? কপাল। যাদের কপাল ভালো হয় তাদের বেশি লেখাপড়া করতে হয় না।”
— “কত দেয় জানো?” অন্য একটা হাত দিয়ে মুখটা একটু আড়াল করে লো ভয়েসে — “কত দিচ্ছে জানো? আরে চোদ্দ দিচ্ছে চোদ্দ। ভাবো? কি কপাল। আরে না না এস সি-টেস সি না গো। মুখার্জি। বুঝলে না? ওর পদবি মুখার্জি।”
ট্রেনে ভিক্ষা চাওয়ার রীতিও যুগের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে।
আজকাল হয়েছে বুকের কাছে ঝুলিয়ে বা ব্যাগ রাখার তাকে একটা বক্স তুলে দিয়ে হাতে ওয়্যা রলেস মাইক নিয়ে ভুলভাল সুরে গান গেয়ে তারপর পয়সা চাওয়া। না দিলে তারা দু-চার কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না।
অন্ধবর-অন্ধবৌ হাত ধরে, অন্ধবাবার হাত ধরে মেয়ে বা ছেলে, বিকলাঙ্গ পুরুষ ট্রেনের মেঝেতে পা ঘষে ঘষে এরা তো আছেই। এছাড়াও -
এই ট্রেনে কয়েকজন ফিক্সড তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ওঠে। তাদের পয়সা চাওয়ার ধরণ বেশ আলাদা। এসেই আশীর্বাদের ছলে সবার মাথায় হাত রাখে আর মঙ্গল কামনা করে। যারা পয়সা দেয় তাদের আরো বাড়তি মঙ্গলবাণী জোটে। তাদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে দু-চারটে কথাও বলে যায়। “তোর পাশে ওটা কে বসে গো? ছেলে? বাহ!” বলেই তার মাথাতেও হাত রেখে আশীর্বাদ করে। গাল টিপে আদরও করে দেয়।
আর যারা পয়সা দেয়না তাদের — “কিরে? তোদের নেই নাকি? নেই তো তবে আগে বলতে কি হয়েছে? আগেই বলে দিতে পারতিস (মঙ্গলকামনাটা ফ্রি তে দেওয়া হয়ে গেলো)। আমি তো তোদের থেকে জোর করে নিইনা। থাকলে দিবি না থাকলে বলে দিবি। বল আমি কোনোদিন জোর করে নিয়েছি?”
Duronto hochhe.chaliye jao.
ReplyDelete