সঙ্কোচ

ছোটবেলায় কাঠি আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করতাম। একবার পাড়ায় আইসক্রিমওলা এসেছিলো, আমার হাতে পয়সা ছিলো না। কিন্তু বাড়ির কারো কাছে চাইতে পারিনি।
 
কানের দুল কেনার নেশা ছিলো। টিফিন খাওয়ার পয়সা বাঁচিয়ে দুল কিনতাম। কোনোদিন দুল কেনার জন্যে আলাদা করে পয়সা চাইতে পারিনি।

বাড়ি থেকে হাইস্কুল তিন কিলোমিটার দূরে। হেঁটে ফেরার সময় কখনো কাউকেই বলতে পারিনি - “প্লিজ তোমার সাইকেলে একটু নিয়ে চলো।”

ক্লাসে কিছু বুঝতে না পারলেও স্যারকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। যদি সবাই বোকা ভাবে।

কখনো পড়ে গেলে, তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে জামা ঝেড়ে চলে গেছি। পাছে কেউ দেখে ফেলে। কারো সাহায্য চাইনি।

রাস্তায় কখনো খুব খিদে পেলেও পেটে ছুঁচোর ডন নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। একা কোনো দোকানে ঢুকে খাবার কিনে খেতে পারিনি।
 
বাবা-মা’র প্রেম সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু তাদের কখনো জিজ্ঞেস করতে পারিনি।  
 
ক্লাসে একটা ছেলের  হাতের লেখা উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম — খুব সুন্দর। তাকে সেটা বলতে পারিনি। 

বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় দেখতাম মিতালিদি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সুন্দর সুন্দর চুড়ি পরতেন। চুড়িগুলো কিসের এবং কোথায় পাওয়া যায় খুব জানতে ইচ্ছে করতো। কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে  পারিনি।  

স্যোশালে একবার রূপংকর এসেছিলো। আমার পছন্দের "তুমি কি এখনো একা বিকেলে আনমনে আমাকে ভাবো" - গানটা গাইবার অনুরোধ পাঠাতে পারিনি। 
  
জার্মান ক্লাসে নাটালিয়া সবুজ আপেল খেতো। দেখে আমার লোভ হতো। একদিন সে আমাকে অফারও করেছিলো। তবুও সেদিন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিলো - নাইন ডাঙ্কে (নো থ্যাংক্স)। 

বাসের জেনারেল সিট ফাঁকা দেখেও কখনো বসতে পারিনি।  

কন্ডাক্টরের আঙুলের ফাঁকে অনেকগুলো দশ টাকার নোট দেখে খুচরো চাইবো বলে একটা একশো টাকার নোট বের করেছিলাম। পাশে বসা লোকটা তাকিয়ে ছিলো বলে, টাকাটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম।

একদিন স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম নুন-লেবু- বরফজল স্টলটা বন্ধ। স্টলের বেঞ্চের কোণাটা একটু বেরিয়ে। আমার আগে কেউ হয়তো সেটা টেনে নিয়ে বসেছিলো। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম, তবুও বসতে পারিনি। 
 
ট্রেনে এক মহিলাকে খবরের কাগজ কোলে নিয়ে রোজ বসে থাকতে দেখেছি। অনেকবার পড়তে ইচ্ছে হয়েছিলো। তবুও চাইতে পারিনি।

একজন মহিলা ট্রেনে রোজ সোয়েটার বুনতে বুনতে যেতেন। কতবার ভালো ডিজাইন বুনতে দেখেছি। কোনোদিন মুখ ফুটে আমার ভালোলাগাটা বলতে পারিনি।

স্টেশনে অনেকটা হেঁটে গিয়ে প্লাটফর্মের শেষে লাইন পেরিয়ে উল্টোদিকের প্লাটফর্মে উঠি। সেদিন লাইন পেরোনোর সময় উল্টোদিকের ট্রেন এসে গেছিলো। আমি প্রাণপণে দৌড়চ্ছি দেখে অনেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল মাঝখানেই আমাকে টেনে তুলে নেবে বলে। শেষপর্যন্ত ট্রেনটা আমার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি কারো হাত ধরতে পারিনি।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত