সবই মায়া

সকাল নটায় বেরোলাম। ট্রেন নটা ছত্রিশে। আসে চল্লিশে। তড়িঘড়ি বেরোনো। বেরোনোর সময় সাতপাঁচ না ভেবে চট করে, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং একটা চামড়ার স্যান্ডেল টেনে নিলাম। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তবুও শাড়ির সঙ্গে কিটোটা বড্ড বেমানান। বরকে বললাম অফিস যাওয়ার সময় আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিতে। তাই হলো। হুশ করে স্টেশন। তারপর নামমাত্র হাঁটা। সামান্য জলও পেরোতে হলো।

স্টেশনে আমাকে দেখেই আমার কলিগ চেঁচিয়ে উঠে বললো, “একি? তুই আজকে শাড়ি? মরণদশা এই বৃষ্টিতে, পারিসও বটে তুই। ও তোর তো আবার বৃষ্টিই ভালো লাগে।”  সহযাত্রীরাও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলো। “হ্যাঁ গো, আমার তো বৃষ্টি খুব পছন্দ” বলেই, হেসে হেসে তার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে কেমন একটা ফিলিং হতে থাকলো। খুব চেনা ফিলিং।

আস্তে আস্তে পা টেনে তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার সময় বোঝার চেষ্টা করলাম, কি হয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আক্ষরিক অর্থে পায়ের তলার মাটি গেলো সরে। বুঝলাম জুতো থেকে জুতোর সোল আলাদা হতে চাইছে। হাঁটতে গেলেই দেখি ডগার দিকটা আলাদা হয়ে ঝুলছে।  জলে পা ভেজাতে চটি অমন আহ্লাদে হয়ে গেলো, নাকি অনেকদিন ওটা পরিনি বলে, কিছু বুঝলাম না।

আহ্লাদে চটি নিয়ে এগোনো ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই শিয়ালদার ট্রেন। মুহূর্তে জনসমুদ্র। হঠাৎ মাথায় এলো, স্টেশন থেকে একটু দূরেই অটো স্ট্যান্ডের কাছে একটা বাটা আছে।

চুপি চুপি পা টেনে ওখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা। খোঁড়া মেয়ের মতো ধীরে ধীরে একহাতে শাড়ি ধরে স্টেশন থেকে আবার নিচে নামার চেষ্টা করলাম। আর ওই ভিড় সব সময় সবাইকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সবাই সবার আগে পৌঁছনোর জন্যে দৌড়য়। আমাকে খোঁড়া ভেবে সবাই ক্ষমা করে দিলো, ঠেলে ফেলে দিলো না।

আমি ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে বাটার দিকে এগোতে থাকলাম। হেঁটে তিন মিনিট লাগার কথা, সেদিন সাত মিনিট লেগেছিলো। মাথায় ছাতা, হাতে একটু উঁচু করে ধরা শাড়ির কুচি, চলনে বেশ অপটু। সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছিলো, সেটা আমার অসহায়তার কথা ভেবে, নাকি অন্য কিছু তখন বিন্দুমাত্র  ভাবার চেষ্টা করিনি।

হাঁটতে হাঁটতেই জুতোর পুরো সোলটাই জুতোর মায়া ত্যাগ করে রাস্তায় দেহ রাখলো। আমি এগিয়ে যাচ্ছি, পিছনে হিল অংশটা পড়ে রইলো। এক পেয়ারাওলা ভাবাচ্যাকা খেয়ে আমার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বাটার কাছে পৌঁছলাম।

দশটা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। পাশের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম কটায় খুলবে? উত্তর এলো সাড়ে দশটা। নিরুপায় হয়ে তাদের দোকানের শেডের তলায় দাঁড়িয়ে অন্যদের সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে থাকলাম। শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা কেমন বোকা বোকা দেখায়, তাই ফোন বের করে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট-ফোনে ব্যস্ত হয়ে সময় কাটাতে থাকলাম।

ঠিক দশটা পঁয়ত্রিশ। তিনজন বয়স্কলোক তিনখানা চাবি নিয়ে শাটারের তালা খুলতে লাগলো। একটা তালা গড়বড় করছিলো। অনেক ঠুকে ঠুকে তাকে খোলা গেলো।

যেন প্রাণ আসলো ধড়ে।

খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার দুঃখের কাহিনী তাদের বলতে বলতেই জুতো বেছে দাম চুকিয়ে পুরোনো জুতো তাদের দোকানেই ফেলে রাখলাম। সবাই হাসলেন।

নতুন জুতো পায়ে দিয়ে স্বাভাবিকের থেকেও অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পেয়ারাওলার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ গর্বের সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে গেলাম, আমার মুখ নির্বিকার নয়। অনেক দৌড়ে এসে দশটা ছত্রিশ মিস হয়ে গেলো। বেঞ্চ ফাঁকা। আরাম করে বসে ফোন বের করে সাতকাহন করতে করতে পরের ট্রেনের অপেক্ষা।

সেদিন ছিলো আমার বিবাহবার্ষিকী।

এরপর ঐ রাস্তা দিয়ে রোজ হাঁটি, কিন্তু মৃত জুতোর আত্মাকে আর খুঁজে পাইনা। সে আমার মায়াও ত্যাগ করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত