মহিলা কামরা ৮ : অন্য এক পথে

সকাল আটটা দশ। এ এক অন্য মহিলা কামরা। উঠেই দেখি কামরার একটা দিক পুরো ফাঁকা। ভাবলাম এই দিকের কামরা বুঝি এমনই হয়, তায় আবার এতো সকাল। গুছিয়ে জানলার ধারে বসলাম।


একটা স্টেশন এলো। হুড়মুড় করে সবাই উঠেই ফাঁকা দিকে ধেয়ে এলো। অন্যদিক থেকে অন্যরা চিৎকার করে সাবধান করতে লাগলো, “ওদিকে নোংরা, যেও না যেও না।”


আমার টনক নড়লো। চারদিক চনমন করে তাকিয়ে নোংরা খুঁজতে লাগলাম। ট্রেনের মেঝেতে খাবারের প্যাকেট, ঘুগনির বাটি, লেবুর খোসা এসব ছাড়া আশেপাশে কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। এ আর কি এমন নোংরা, আমাদের এখানে ট্রেন তো এমনই হয়।


স্বচ্ছ ভারত করতে হবে, স্বচ্ছ ট্রেন তো নয়!


তবুও মনে হলো, আমি বুঝি নোংরাটা দেখতে পাচ্ছি না। উঠে অন্যদিকে চলেই যাই। গিয়ে দেখলাম ততক্ষণে আর কোনো সিট ফাঁকা নেই। অনেকদূর যাওয়া, তাই ফিরে এসে আগের জায়গাতেই বসলাম।


প্রতিটা স্টেশন আসে, লোকজন ফাঁকা দিকে ধেয়ে আসে, সবাই সাবধান করতে থাকায় আবার ফিরে গিয়ে ওই দিকেই ভিড় করে। আমি একা অমন সাহস করে বসে থাকায় লোকে আমাকে হয়তো পাগলই ভাবছিলো। কিচ্ছুক্ষণ পর কেউ আর অন্যদের পাত্তা না দিয়ে আমাকে দেখে ভরসা পেয়ে বসতে এলো।


আমার সিট, আমার উল্টোদিকের সিট, ডানদিকের সিট, তার উল্টোদিকের সিট, সব মুহূর্তে ভর্তি হয়ে গেলো। পিছনের লম্বা সিট আর তার উল্টোদিকের চারজন করে বসার সিট দুটো যথারীতি ফাঁকা রয়ে গেলো। নোংরা নিশ্চয়ই ওখানেই আছে। এদিকের মহিলারা তখন ওইদিকটা রক্ষা করতে লাগলো সবাইকে সাবধান করে।


অনেকদূর যাওয়ার পর জানা গেলো কেউ একজন পটি করে রেখেছে। তাই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গেলো। কেউ বললো, শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে, কেউ বললো তোদের পেটে নেই? কেউ বললো গন্ধ আসছে, কেউবা বললো এমন করার কি আছে? একি আর তোর আমার মতো ভালো লোকে করেছে? কোনো পাগলেই হয়তো...।  একজন গালাগালি দিতে শুরু করে দিলো, যারা রাতের ট্রেনে গেছে তাদেরই এইসব কাজ, সকালে তো আর জায়গা পাবে না তাই। ইতিমধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের একজন উঠেই কর্কশ গলায় বলতে লাগলো, “তোরা পটি করিস না? তোদের পিছনে থাকে না? নিজের মন শুদ্ধ হলেই সব শুদ্ধ। এতো বিচার করার কি আছে?”


তারপর আমার পাশে বসা মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার হাতে মোটা মোটা ওগুলো কি গো? শাঁখা?”  
সে মুচকি হাসতে হাসতে বললো, “কেন? তোর কি মনে হচ্ছে? প্লাসটিক?”
“না, মানে এতো মোটা মোটা শাঁখা দেখা যায় না তো, বেশ সুন্দর লাগছে।”
“সুন্দর তো লাগবেই, এগুলো আমার স্বামী দিয়েছে। তোদের তো সব স্বামী দেয় না আসামী দেয়। তোদেরগুলো সব আসামী আমারটা স্বামী।” বলেই হো হো করে কামরা ফাটিয়ে হাসলো।  


এদিকে পেয়ারাওলাকে একজন বলতে লাগলো, “পুরোনো এক টাকার কয়েনটা বদলে দাও। এই বড় কয়েন কেউ নিতে চায় না।”
পেয়ারাওলা বললো, “আমাকে তো তোমাদের মতোই কেউ দিয়েছে, আমি তো নিয়েছি।”
“তাও তুমি পালটে দাও, আমাদের ওদিকে কেউ নিতে চায় না।”
“কি মুশকিল আমি কোনদিকে যাই, এই নাও ছোট এক টাকা।”


অন্য অনেক মহিলাও বলতে থাকলো “হ্যাঁ গো এখন খুব মুশকিল হয়েছে, এই বড় এক টাকার কয়েনগুলো কেউ নিতে চাইছে না।”


আমার উল্টোদিকে বসা একজন শুরু করলো, “এখানে নেয় না বলছো? বড় বাজারের মতো জায়গাতেও নেয় না। ওই শহরে। মাল আনতে যাই তো, খুচরো দিলেই তারা ঝামেলা করে, বলে আমরা ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করি। তোমাদের তো আর ভ্যাট দিতে হয় না। নোট দিতে না পারলে মাল হবে না। পুলিশ দাঁড় করিয়ে রেখে বড় বড় ব্যবসাদাররা এইসব বলে, পুলিশ যদি তাদের শাস্তি না দেয় আমরা কি করবো বলো? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার আছে? মুখের উপর তারা খুচরো ফিরিয়ে দেয়, পুলিশ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখে।”


একজন নাতনি নিয়ে উঠলেন। তৃতীয় লিঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আদর করতে থাকলেন। নাতনির ঠাকুমা গদগদ হয়ে বললেন, “ও তোমাকে খুব চেনে, বলে, ঠাকুমা মামার বাড়ির কাছের সেই দিদা যে রোজ সকালে গান করে, সে আজ ট্রেনে উঠেছিলো। ওই দিদা খুব ভালো।”


দিদা আদরের মাত্রা বাড়িয়ে একটু পরে নেমে গেলেন।


ঠাকুমার বাড়িতে এই নাতনি কত আদরের তাই সবাই শুনতে লাগলো। একদম তোলা কাপড়। নাতনির গায়ে অনেক বড় বড় ফোস্কা ফোস্কা ঘা হয়েছে। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে। জানা গেলো নারাঙ্গা বলে একটা ঘা হয়েছে। শুনে সবাই বললো নারাঙ্গা ফল বাঁধোনি? নারাঙ্গা গাছেই ডাল? ঠাকুমা বললেন, “বেঁধে ছিলাম, আজকালকার ডাক্তার বলেছে, ওসব খুলে ফেলে দেবে, এই মলম আর একটা পাউডার দিচ্ছি লাগাবে। তাই ফেলে দিয়েছি। হাতে শুধু নারাঙ্গা ডালের বালা দুটো রেখেছি।”


পটির গবেষণা তখনো শেষ হয়নি। এক মহিলা বাচ্চা নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, পটির সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ফাঁকা লম্বা সিটের উল্টোদিকে এক কোণায় গিয়ে বসলো।


ওই নারাঙ্গা ফলটার কথা শুনে আমি ছোটবেলায় ফিরে গেলাম। ওটার সঙ্গে আমি খুবই পরিচিত। ফলটা জলে ভাসে। আমরা ছোটবেলায় একঝাঁক মিলে যখন পুকুরে চান করতাম, সবাই গোল করে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফলটা নিয়ে খেলতাম। খেলাটা এমন - দুটো দল। একদল দুহাত দিয়ে জল তোলপাড় করে ফলটা ক্রমাগত লুকোনোর চেষ্টা করতো, তার মধ্যে থেকেই অন্যদলকে খুঁজে বের করতে হতো। সবাই তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ করে চিৎকার করতে করতে লাফালাফি করে ফল লুকোতো, অন্য দলও একই চিৎকার করে খোঁজার চেষ্টা করতো।


আমার মন সেই তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ চিৎকারে ডুবে গেলো। হঠাৎ সবাই ব্যস্ত হয়ে এদিকে চিৎকার করতে থাকলো, “ডায়মন ঢুকছে, ডায়মন ঢুকছে”।

আমিও সম্বিত ফিরে পেয়ে “ডায়মনে” নেমে গেলাম।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত