বেস্ট ফ্রেন্ড
-- মা, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?
-- উমম! তুমি।
-- সেকেন্ড বেস্ট?
-- এইরে! ভাবতে হবে!
-- কেন? আমি আর বাবা ছাড়া অন্য কে? সেটা বলো।
-- আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই…
-- সেকি? ভাবতে হবে? আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।
-- কেন?
-- কেন? আবার জিজ্ঞেস করছো? তোমার মা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড নয়? আমার তো তুমি বেস্ট ফ্রেন্ড।
-- হুম! আসলে কি জানতো, আমি তো অনেকদিন হলো, আমার মায়ের কাছে নেই, আর মা আমার থেকে অনেক দূরে থাকে, তাই ঠিক সব কথা বলা হয়ে ওঠে না, আর দিদুনকে এখন সব কথা বলাও যায় না…
মাঝখানে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে, ‘তো কি হয়েছে? তোমার মা তোমার থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকে, তাতে প্রবলেমটা কি? ঋতীষাও তো আমার থেকে দূরে থাকে। আমিও কি রোজ তার কাছে থাকি? তবুও তো সে আমার একজন বেস্ট ফ্রেন্ড।’’
হ্যাঁ, আমার আর রুহানেরই কথোপকথন। তার মনে অনেক কৌতূহল অনেক জিজ্ঞাসা। মাঝে মাঝে উত্তর দিতে গিয়ে থেমে যেতে হয়।
দুজনের খুনসুটির মধ্যেই, প্রতিদিনের মতো মা'কে ফোন করলাম। কেমন আছো? জিজ্ঞেস করার পর, ‘'না, না একদম ভালো নেই!” কথাটা এমনভাবে বললো, মনে হলো, কাল বেরিয়ে পড়লে কেমন হয়। আর রুহানের দেওয়া খোঁচায় কোনো উত্তর খুঁজে না পাওয়াটাও ছিলো একটা ব্যাপার।
রাতেই মনে মনে ঠিক করে ছোট্ট একটা ব্যাগ গুছিয়ে ফেলা। মোবাইলে এলার্ম ভোর চারটে পনেরো। হাওড়া থেকে ট্রেন ছটা বত্রিশ। রেডি হয়ে বেরিয়ে চনমনে মনে লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হয়েই এস ফাইভ। উঠেই চাদরমুড়ি। চোখ বন্ধ করে হাওড়া। হাওড়া থেকে সঙ্গী হলো শুভ। শুভ আমার দিদির ছেলে।
সকালবেলার ট্রেনের কামরা, তায় রবিবার। ভীষণ ফাঁকা যেখানে খুশি বসে যাওয়া। ট্রেনের কামরা যখন হকার তো থাকবেই। সেখানেও কোনো ভানুদা, দেবরাজদা, রাজকুমারদাদের ভিড়। শুধু আঞ্চলিক ভাষার কারণে সুরটা আলাদা। চলন্ত লোকাল ট্রেনে চা বিক্রি আমি প্রথম দেখলাম। আগে কোনো লোকাল ট্রেনে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। এমনকি এই হাওড়া তারকেশ্বরেও। সুর করে করে লেবু চা, লিকার চা, দুধ চায়ের সঙ্গে কুড়ি টাকায় পাঁচটা কমলালেবু বেশ অবাক করে দিয়েছে। আগের দিনেই যাদবপুরে পঞ্চাশ টাকায় পাঁচটা ব্যাগে ভরা। আঙুর উঠলো। সুর ছিলো মিষ্টি আঙুর ফল। সস্তা হলেও আমার কাছে টকই রয়ে গেলো। গামছা। ‘'এই যো বড় বড় গামছা, মুছে আরাম পাবেন।” তার একদিকে প্রিন্ট, একদিক চেক। যাকগে অনেক সস্তা জিনিস দেখেই গেলাম। একের পর এক স্টেশন, লাইনের দুপাশে কলাবাগান, খেতের ফসল পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছলো তারকেশ্বর। নামার সময় দেখা গেলো, অনেকজন নানান বয়সের লোক ধুতি, পাঞ্জাবি পরে ট্রেনের প্রতিটা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। প্রথমে ভাবলাম, কুলি নাকি? অবাক হলাম। আগে কখনো এমন দেখেছি বলে মনে পড়লো না। লোকাল ট্রেনে কুলি থাকবেই বা কেন! অতো সকালে কখনো আমি ওই ট্রেনে যাইনি, আর গেলামই প্রায় দশ বছর পর। তখন ছিলো সিঙ্গেল লাইন। নামার পর বুঝলাম তারা মন্দিরের পান্ডা। যারা মন্দিরে পুজো দিতে চায় পিকেটিং করে তাদের ধরার চেষ্টা করছে। কি করতে হবে না হবে, সব বলে দিচ্ছে। শুধু পুজো দিলে টাকা লাগবে না। যদি থাকতে চায়, রুমে এটাচড বাথ, টয়লেট আছে। সব ধরনের গাইডেন্সই তারা দিয়ে দিয়ে লোক ধরার চেষ্টা করছে।
ট্রেনের পরে বাস। আমার পিছনের সিটে বসা এক দম্পতি। বাচ্চাসহ। বাচ্চাটা খুব বিরক্ত করছিলো বলে তার মা বলতে শুরু করলো, ‘'এতো চব্বো করিসনি, চুপ করে বসতে বলছি শোন, নাহলে আমি নেমে পালিয়ে যাবো।’ বলতে বলতেই শুরু হলো, জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে মায়ের বমি করা। তাই দেখে বাচ্চা এমনিই চুপ করে গেলো। আমি আমার গন্তব্যের কথা ভাবতে লাগলাম।
আমাদের বাসস্ট্যান্ডে নেমে চড়ে বসলাম একটা টোটোয়। খুব ধীর গতিতে ব্যাটারির ক্ষীণ আওয়াজে টোটো এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের রাস্তা আর রাস্তার ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো এখন আর গ্রাম্য নয়। সরষের খেত, হালকা সবুজ ধানের চারা বুঝিয়ে দেয় গ্রাম। মাঠের ফাঁক দিয়ে পাড়ায় যে রাস্তাগুলো চলে গেছে সেগুলোও এখন কংক্রিট। জমির আলগুলো এখনো কংক্রিট দেখেনি। টোটো থেকে নেমে টোটোওলাকে পয়সা মেটানোর আগে একজনকে দেখে আমি দৌড়। চিৎকার করে বললাম, শুভ পয়সাটা মিটিয়ে দে।
একজন বয়স্ক মানুষ ডান হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছেন। সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি। পিছন থেকে ঠিকই চিনেছিলাম। বাংলা সাহিত্য পড়তে এসে প্রথমেই যাঁর কথা আমার মাথায় আসে, তিনিই। আমাদের জুনিয়র হাইস্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই নন্দবাবু। সেই একই চেহারা। দীর্ঘদিন পরে দেখেও হুবহু মিলিয়ে নিতে পারলাম। যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। আনন্দে আপ্লুত হয়ে গরগর করে বলতে লাগলাম, স্যার বহুদিন ভেবেছি, আর কি কোনোদিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে না! স্যার বললেন, মনে যে দাগ টানবে, সে দাগ ঠিক রয়ে যাবে। অন্যান্য স্যারদের খবরও জানলাম। দুজন স্যার মারা গেছেন। উনি একগাল হেসেই বললেন, ওনারা ওপারে, আমি আছি, উমুক আছেন, তুমুক আছেন। চুপ করে সব শুনছিলাম। তার পরেই স্যার হঠাৎ শুরু করলেন, “আসলে জানিস তো, বাংলা আর সংস্কৃতে কত রস।” থামিয়ে দিয়ে বললাম, আজ একদম পড়াশুনো নয়। আপনি নিজের কথা বলুন, কেমন আছেন, কি করেন, ছেলেমেয়েদের খবর। সব বললেন, তার মধ্যে একটা খুব দুঃখের খবরকে মেনে নিয়ে বললেন, ছোট ছেলে বেঁচে আছে এটুকুই সৌভাগ্য। মানে? আঁতকে উঠলাম। বললেন, সে এক বড় দুর্ঘটনা। আগস্টে ঘটেছে। ছোট ছেলে এগারো হাজার ভোল্ট কারেন্ট খেয়ে কারেন্টের খুঁটি থেকে ছিটকে নিচে পড়েছে। তার একটা হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে। আর একটা হাতের অবস্থাও ভালো না। শুনে মন খারাপ হলো। মেয়ে আর বড় ছেলের গল্পও শুনলাম। স্যার এখনো সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন? হ্যাঁ। ওতেই ভালো থাকি। আমি এখনো বেশ আছি। বারো তেরো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েই উনি আমাদের স্কুলে আসতেন। এখনো কি সাইকেল চালিয়েই এসেছেন? না, গিন্নিকে এনেছি তো, তাই সাইকেলে আসিনি। আমাদের গ্রামে ওনার শিষ্য বাড়ি। সেখানেই এসেছেন তিনি। তেমনই আছেন উনি। বললাম, স্যার আপনার একটা ছবি তুলি দাঁড়ান। বকাবকি করে ঋজু শিরদাঁড়া আরো ঋজু করে দাঁড়ালেন। বয়সের এতোটুকু ভার নেই। কিছুই বদলায়নি। দাঁতের কারণে সব দাঁত তুলে দিতে হলেও হাসিও কিন্তু অমলিন। স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম।
একবছর পর মায়ের সঙ্গে দেখা। সব গল্প যেন এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। খুব তাড়া। আজই চলে যাবো। মায়ের প্রথম রাগ, একা কেন? থাকবো না কেন? যা হয়…! মা'কে বুঝিয়ে আবার বাইক চড়ে বেরিয়ে গেলাম। বারো কিলোমিটার পথ। নিজের টুকটাক কাজ সেরে দিদিদের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এলাম লাঞ্চের আগে। মা বসেছিলো, তখনো ভাত খায়নি। মাকে বললাম, মেজোমাকে দেখে আসি তারপর খাবো।
কয়েকদিন আগে মেজোমা'র স্ট্রোক হয়েছিলো। তিনদিন কথা বলতে পারেনি। কাজের চাপে যেতে পারিনি। ফোনেই খোঁজ নিচ্ছিলাম। এখন একটু সুস্থ আছে। কথা বলতে পারছে, আস্তে আস্তে হাঁটাচলাও শুরু করেছে।
দুপুরে খাওয়ার পর সবাই বসেছিলাম। মেজোমা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বললো, 'গাছে দুটো বড় বড় পেঁপে আছে, তোর ব্যাটার জন্যে নিয়ে যা। খাবে।' বোঝালাম, আমি নিয়ে যেতে পারবো না। ছেলে আজকাল পেঁপে খায় না। গাড়ি করে এলে দিও। তার আবদারের কাছে হার মানতে হলো।
আমি বাড়ির কচিকাঁচাদের সঙ্গে আড্ডায় বসলাম। একটু আড্ডা দিয়ে আবার ফিরবো। মা আর মেজোমা দুজনে চেয়ারে বসে রইলো। বললাম, দুজনে একটু রেস্ট নাও। শুনলো না। মেজোমা আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে কাল অনেকবার কেঁদে ফেলেছে। কত পুরোনো গল্প। ওই বাড়ি জড়িয়ে কত স্মৃতি। এখনই যেন বেলাশেষের গান তার কানে বাজছে। মন ভার হলো। তবুও অপার আনন্দ। আমার বাড়ি, আমার ছোটবেলা, আমার সবাই। তাই সবাই অবুঝ, ‘যেতে নাহি দিব’ থেকে বেরোতে চায় না। বললাম যেতেই হবে। কাল কলেজ আছে। ছেলেকে রেখে এসেছি, থাকতে পারবো না। বহুদিন পর মুঠো ভরে আনন্দ কুড়িয়ে ফিরে এলাম।
মা আর মেজোমা যারা দুজনে যৌবনে ছিলো, একটু হলেও বেঁকা চোখ, আজ তারা নিঃসংকোচে সারা দুপুর। কি নিবিড় তাদের গল্প। বিষয়ে হতাশা, দুঃখ, কষ্ট থাকলেও, অসুস্থ শরীরে চেয়ারে বসেই ভাগ করে নিলো একে অপরকে। একে অপরের প্রতি কি নালিশ। তোর মা একটুও হাঁটে না, এটা করে না, ওটা করে না। অন্যজন, তোর মেজোমা একটুও ফল খায় না, ভালো কিছু খায় না… এন্ড সো অন। ছোট্ট রুহান কি সত্যিই জানে এই সম্পর্কটাকে কি বলে? ওই একটা ছোট্ট সুপারলেটিভ ডিগ্রি, ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ শেষমেশ কার নামের আগে গিয়ে থামবে? তার উত্তর ও কবে পাবে জানি না, আমি তো এখনো পাইনি।
Comments
Post a Comment