বাংলার জল

ছোটবেলায় সন্ধ্যেবেলা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম। খুব মনে পড়ে, বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে একধরনের ডানাওয়ালা পিঁপড়ে আলোর চারপাশে ঘুরতো। গায়ে মাথায় বসে ভীষণ বিরক্ত করতো। আমরা সেগুলোকে বাদলপোকা বলতাম। একদিন সন্ধ্যেবেলা পোকাগুলো খুব বিরক্ত করছিলো বলে আমি ধরে ধরে হ্যারিকেনের মাথা দিয়ে তাদের আগুনে ফেলে দিচ্ছিলাম। তারা ছটফট করে তার মধ্যেই মরে যাচ্ছিলো। কয়েকটা করার পর দেখতে ভীষণ খারাপ লাগছিলো বলে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর মারিনি।

পরেরদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম দীপিকারও একই প্রবলেম হয়েছে। সে বিরক্ত হয়ে পাশে একবাটি জল রেখে দিয়েছিলো, পোকাগুলো উড়ে উড়ে তাতে পড়ে আর উঠতে পারছিলো না। তারপর যা হয়। এই গল্প চলার মধ্যেই দীপিকা আমাকে বলেছিলো, তুই কি নিষ্ঠুর রে, পোকাগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে মারলি? ছোট বয়েস, তাই উত্তর দিয়েছিলাম, ওঃ আগুনে পুড়িয়ে মারলে নিষ্ঠুর, জলে ডুবিয়ে মারলে নিষ্ঠুর না?

এখন মনে হয় কাউকে মারাটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় নয়, কিভাবে মারছি সেটাই নিষ্ঠুরতার পরিচয়।
তাই জন্যেই আমার মাথায় কাজ করে, রেপিস্টদের ফাঁসি দিয়ে শহীদের মতো মারার চেয়ে, দীর্ঘদিন ধরে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মারা উচিত।

আজ কলেজে এসেও ফসফস করে কালো হিটটা চালিয়ে দিলাম। এনকাউন্টার করার মতো। নিজেকে সিরিয়াল কিলারও মনে হচ্ছিলো। সত্যি সত্যি বাথরুমে ঢুকে দেখি বেসিনে এতো লাশ পড়ে। দেখে খুব খারাপ লাগছিলো। কিন্তু ওরাও কেন আমাদের মতো বোঝে না, কে জানে।

রাস্তায় আসার সময় একটা ছেলে আমার সামনে তার রিক্সায় জল ঢাললো। রাস্তার ধুলোটা জলের সঙ্গে এসে আমার জুতো, জামা নোংরা করে দিলো। আমি তার দিকে তাকাতেই সে একগাল হাসলো। আমি বললাম, এটা কি হলো? বললো, “আমি কি করবো?”
ভাবলাম, সেই! তুমি কি বা আর করবে! সরি বলার জায়গায় তুমি যদি হাসতে পারো, তোমার আর কিছু করার থাকে না।

কলেজ যাওয়ার পথে একটা মিষ্টির দোকান থেকে এক লিটার করে জল কিনি। আগে একোয়াফিনার বোতল দিতো, কুড়ি টাকা নিতো। কিছুদিন একোয়াফিনা আসছে না, একোয়া ডায়মন্ড দেয়। আমি এই কোম্পানির জল আগে কখনো খাইনি। দামও জানতাম না। ওরা কুড়ি টাকা করেই নিতো। জলের কাউন্টারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনজন থাকে। দুই মহিলা আর একটা ছেলে। একদিন দেখলাম ছেলেটা সতেরো টাকা নিলো। তারপর একদিন এক মহিলা পনেরো টাকা নিলো। আর এক মহিলা কুড়ি টাকাই নেয়। আজ আমি বললাম, এটা পনেরো নেয়। বলতে পাঁচ টাকা ফেরৎ দিলো। এক দিদির কাছে গল্পটা বলায়, সে বললো প্রিন্ট কত আছে দ্যাখো। দেখা গেলো সতেরো টাকা। এখন সতেরোই নেয়।
কম দাম বলে জলের কোয়ালিটি নিয়ে একদিন ছোট্ট করে সন্দেহ প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কম দাম বলে খারাপ জল ভাবার কিছু হয়নি। এটা আমাদের বাংলার কোম্পানির জল। এই জল আগরপাড়া থেকে আমরা নিজেরা গিয়ে নিয়ে আসি। এর জন্যে আমার গাড়িই কিনে ফেলতে হলো। দুরকম জলই তো খাচ্ছেন, তফাৎটাও বুঝবেন।” কথা শুনে মনে হলো মালিকই হবেন। ডি ডি গেঞ্জির উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করার মতোই আমি ওনার কথার উপর ভরসা করে একোয়া ডায়মন্ড কিনেই কলেজে যাই।

ফেরার পথে নিজের মনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, রিক্সা ডাকার চেষ্টাও করিনি। অটো ফাঁকা পেলে উঠে যাবো এমন ইচ্ছায়। এক রিক্সাওলা এসে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো যাবো কিনা। আমি ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম। বললো, খুশিসে যো আপকি মর্জি। বললাম, মর্জির কিছু নেই, একজন দশ, দুজন কুড়ি। কেউ কেউ একজন পনেরো, কুড়িও নেয়। তারপর সে বকবক শুরু করলো। আমি ওই কলেজের টিচার কিনা, কোথায় বাড়ি, আমি হিন্দুস্তানী নাকি বাঙালি। সে রাস্তার সবার সঙ্গেই বাংলা বলছিলো, শুধু আমার সঙ্গে হিন্দি। পরে বুঝলাম, ও আমাকে হিন্দুস্তানী ভেবে এটা করছিলো। তারপর বললো, “আমি হিন্দুস্তানী, বাংলা বলতে পারিনা।” আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছি কিনা তাও জানতে চাইলো। কথা বলতে বলতেই ওয়াক থু করে থুতু ফেললো। থুতু হাওয়ায় কোথায় গেলো কে জানে, আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, রাস্তায় এমন করে থুতু ফেলবেন না। বিশেষ করে চালাতে চালাতে। হাওয়ায় উড়ে এটা আমার গায়ে আসতে পারতো, অন্য কারো গায়েও যেতে পারে। তাছাড়া রাস্তাঘাটে থুতু ফেলা ঠিক কাজ নয়। বাধ্য ছেলের মতোই আর হবে না ম্য্যাডাম বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছে। বাকিটা তার হাতে। তারপর জানতে চাইলো, আমি রোজ একা যাই কিনা.. প্রথমে হ্যাঁ বলেছিলাম। আবার জিজ্ঞেস করায় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে পারে ধরে নিয়ে বললাম, না না বন্ধুরাও আসে। কথায় কথায় জানা গেলো, সে কলকাতার কিছুই চেনে না, ভয় পায়। কোন রাস্তা কোথায় চলে গেছে...।
আমার স্টেশন এলো, খুশি হয়ে বারো টাকা দিতে সে বললো, আবার আসবেন।

ফলটল কেনার থাকলে একবারে এইট বি থেকে কিনে নিয়ে ফিরি। ঘুরে ঘুরে সব কেনার সময় দেখলাম একটা দোকানের পাশে দুজন বসে মোবাইলে লুডো খেলছে। একজন মহিলা পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে করে দুজনকেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এটা নয় ওটা, ওটা নয় সেটা চাল দে। মোবাইলে খেলতে আগে কখনো দেখিনি, তাই তাদের ছবিও তুলে রেখেছি। দুজনের একজন হেরে গেলো। তাই নিয়ে পাশের দোকানদাররা তাকে খ্যাপাতে শুরু করলো। তারপর বেশ সিরিয়াস আলোচনা শুরু হলো ওখানকার মধ্যে সবচেয়ে কে ভালো খেলে। তাতে বোঝা গেলো রতন সবচেয়ে ভালো খেলে। রতনকে কেউ হারাতে পারবে না।

ভাবলাম “রতন” যখন সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।

হাতে অনেক জিনিস। একটু এগিয়ে এসে অটো ধরার চেষ্টা। এগিয়ে আসার সময় দেখি এক জায়গায় খুব ভিড়। সবার মনেই কৌতূহল, সংশয়, জিজ্ঞাসা। দেখা গেলো জিন্স, টি-শার্ট পরা অল্প বয়সী একটা মেয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে কাঁদছে, আছাড় খাচ্ছে, বসছে, উঠছে আর মোবাইল ফোনে কিছু একটার বর্ণনা দিচ্ছে। তার একজন ছেলে সঙ্গী তাকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

কাছে এগোতে বুঝলাম, খুন নয়, সে কারো মৃত্যু দেখেছে। যেটা তার চোখের সামনে ঘটেছে।

বাড়ি ফিরলাম।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত