শিক্ষক দিবস

আড়ম্বর করে ফেসবুকের দেওয়ালে কোনো “দিবস” জানানোটা পছন্দ করি না। হাস্যকর লাগে। মনে হয় এ আবার হওয়ার কি আছে - আলাদা করে প্রেম দিবস, মা-বাবা দিবস, বোকা বোকা গোলাপ দিবস, বন্ধু দিবস। কৃত্রিম লাগে। প্রতিটা দিনই সব দিবস হতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, কিছু লিখে ফেসবুকের দেওয়ালে শেয়ার করতে চাইলে অনেক ঘটনাই লেখা হয়ে যায়। না হলে অলস মস্তিষ্ক একেবারেই কাজ করতে চায় না।

কাল থেকে একটা ঘটনা বারবার মনে পড়ছে। আমি তখন খুবই ছোট। শিক্ষক হওয়ার মতো বয়েস হয়নি। যোগ্যতা নিয়ে এখনো সংশয় আছে। সাল তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। চাইলেই বের করা যায়। সেদিন আমার বড় জেঠুর এক নাতনির অন্নপ্রাশন ছিলো। ওই দিন দুপুরে আমাদের পাশের বাড়ির পিসেমশাই তালগাছ থেকে পড়ে গেছিলো। সব আনন্দ মাটি হয়ে সবাই ওইদিকেই দৌড়। পিসেমশাই তালগাছে উঠে হাঁড়ি বেঁধে রাখতো। গরমের দুপুরে তালের রস খাওয়ার জন্য। কাজটা তার কাছে খুব সহজ ছিলো, অভ্যেস বলেই। তবু অভ্যেসকে ছাড়িয়ে বিপদটাও ঘটে গেছিলো।

বহু চিকিৎসার পর পিসেমশাই লাঠি ধরে টলে টলে হাঁটতে পেরেছিলো। হাঁটতে পারার পর তার অদম্য ইচ্ছা আর মনের জোর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশার আলো দেখিয়েছিলো। দিন আনা দিন খাওয়া জীবনে আবার রোজগার শুরু করার কথা ভাবতো। আমাকে বলেছিলো, “মা আমাকে একটু নাম সইটা শিখিয়ে দিবি? তাহলে একটা রিক্সা বা ট্রলি ভ্যান কিনবো।”

ছোট্ট মন অনেক প্রশ্ন করেছিলো। “ট্রলি ভ্যান কিনবে, তাতে তো টাকার দরকার, নাম সই দিয়ে কি হবে?”
“না রে, অনেক নিয়ম আছে। তুই বুঝবি না।”

“তাহলে তুমি এক কাজ করতে পারো তো, নিরক্ষরতা দূর করার জন্যে তো এখন অনেকেই বয়স্কদের পড়ায়, তুমি সেখানেও তো পড়তে পারো।”

“আমি কি যেতে পারবো? আমি তো হাঁটতেই পারি না। এই লাঠি ধরে একটু একটু চেষ্টা করি। তুই তো আমার বাড়ির মেয়ের মতো। রোজ বিকেলে একটু করে আমাকে শিখিয়ে দিবি। এই দ্যাখ শ্লেট আর পেন্সিল।”

অনেক প্রশ্ন করলেও মনে মনে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। রোজ শাড়ি পরে রেলিংদের দিদিমণি হওয়ার ভান করে অনেক খেলেছি, কিন্তু একজ্ন সত্যিকারের ছাত্র পাবার খুশি ছিলো অন্য মাত্রার।

রোজ বিকেলে আমি লেখাতে শুরু করলাম। পিসেমমশাই তার দরকারটুকু আমাকে জানিয়ে বলেছিলো, “তুই শুধু আমাকে এটুকু শেখা, আর কিচ্ছু দরকার নেই।”

নাম- নেপাল মাইতি।
গ্রাম - ভবানীপুর।
পোস্ট - ডিহিবাগনান।
থানা - আরামবাগ।
জেলা - হুগলি।  

“আর কিচ্ছু শিখবে না? অ আ, ক খ, প্রথমভাগ, দ্বিতীয় ভাগ।”

“সেগুলো পরে হবে, আগে আমার দরকারটুকু। পঞ্চায়েত থেকে বলে দিয়েছে, নাম সইটা আর ঠিকানাটা লিখতে জানতেই হবে।”

রোজ লেখা চলতে থাকলো। হাত ধরে লেখাতাম। পিসেমশাই অনেকটা শিখেও গেছিলো।

পিসেমশাই আমাকে ঝিঙেফুল বলে ডাকতো। আমরা ছোটবেলায় নেচে নেচে একটা খেলা খেলতাম, ঝিঙেফুল যেতে বলেছে। সেখান থেকেই আমার নাম হয়ে গেছিলো ঝিঙেফুল।

পিসেমশাই মা’কে বলতো, “জানো ছোটবৌদি, ঝিঙেফুল আমাকে রোজ লেখায়। আমি বলেছি লেখা শিখে গেলে একটা রিক্সা বা ভ্যান কিনবো। আমি আবার কাজ করবো।”

একদিন বিকেলে লেখাতে গিয়ে দেখি, পিসেমশাই শ্লেটে বেশ পরিষ্কার অক্ষরে বড় বড় করে লিখে রেখেছে - নেপাল মাতুতুতু।

একটুখানি ভুল হলেও অতোটা একা একা লিখতে পারায় আমি খুব খুশি হয়ে গেছিলাম।

পিসেমশাইয়ের স্বপ্নে আমিও স্বপ্ন দেখতাম। আমি রোজ তার রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়াবো।

আর একটা অনুষ্ঠানের দিন। সেদিন ছিলো আমার ভাইঝির অন্নপ্রাশন। সারাদিন সবাই খুব ব্যস্ত হইহুল্লোড়। সন্ধ্যেবেলা কান্নার শব্দ। পিসেমশাই তার মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এক বোতল কেরোসিন তেল খেয়ে চৌকির পায়াতে গলায় দড়ি দিয়েছিলো।

লাঠি ধরে শিরদাঁড়া সোজা করার পর, মাথা উঁচু করাটা থেমে গেলো।

আমার আর রিক্সা চড়া হয়নি।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত