শারদ শুভেচ্ছা
“ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই উড়তে থাকে ছেলে
বঁড়শী দিয়ে মানুষ গাঁথে মাছেরা ছিপ ফেলে।”
পুজোর সময় কলকাতাকে আমার এমনই মজার দেশ মনে হয়। দু-পা গেলে একটা ঠাকুর, আরো দু-পা গেলে আরো একটা, আরো কিছু পা গেলে অসংখ্য ঠাকুর। এখানে মানুষের সংখ্যা, প্যাণ্ডেলের সংখ্যা, ঠাকুরের সংখ্যা, প্রতিযোগীর সংখ্যা — সব সমান। প্রতিযোগিতার ঘনত্ব আমরা টের পাই টিভি চ্যানেলগুলোর লাফালাফি থেকে, খবরের কাগজের পাতা রাস্তার হোর্ডিং থেকে।
"বাঁশের জালে হাঁসের ঢল, ত্রিকোণ পার্কে দেখবি চল” — এমন সুন্দর সুন্দর ছড়া দিয়ে সব বিজ্ঞাপন।
কাদের প্যান্ডেল সেরা পুরষ্কার পেলো, কাদের প্রতিমা। কাদের একটুর জন্যে পুরষ্কার হাতছাড়া হলো, আর কারাই বা পেলেও পেতে পারতো, সব জানা যায়। পুরষ্কার পেয়ে আনন্দ, হইচই, আবির মাখা নাচ, কারো বা চোখ ছলছল।
গ্রামের পুজোতেও কিন্তু একটা চাপা প্রতিযোগিতা থাকে।
আমার গ্রামের নাম ভবানীপুর। খুব ছোট্ট গ্রাম। আগে লোকসংখ্যাও ছিলো খুব কম। তাই পুজোয় বিশেষ জাঁকজমক করার ক্ষমতা ছিলো না। উত্তরে আর দক্ষিণে দুটো গ্রাম — পাড়াবাগনান আর রাধাবল্লভপুর। পাড়াবাগনান গ্রামে মাঝে মাঝে পুজো হতো, আবার মাঝে মাঝে হতো না। পাড়াবাগনানের ঠাকুরটা হয় একটু দূরে। আমাদের গ্রাম থেকে মেয়ে বৌ-রা ওখানে ঠাকুর দেখতেও যেতো কম। সেটা নিয়ে আমাদের অতো মাথাব্যথাও ছিলো না। আমাদের প্রতিযোগী ছিল রাধাবল্লভপুর।
আমাদের গ্রামের পুজোটা হতো পাড়াবাগনান গ্রামের দক্ষিণপাড়ার সঙ্গে মিলে। পাড়াবাগনান বিশাল গ্রাম। তাদের দক্ষিণপাড়া আমাদের গ্রাম লাগোয়া। তাই আমাদের প্রাইমারী স্কুলটাও একসঙ্গে — “ভবানীপুর পাড়াবাগনান দক্ষিণপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়”।
খুব ছোটবেলায় দেখেছি ওই স্কুলেই আমাদের দুর্গা ঠাকুর হতো। তখন প্যাণ্ডেল বলতে সবার বাড়ি থেকে চেয়ে আনা শাড়ি সেফটিপিন দিয়ে গেঁথে গেঁথে বানানো। ঠাকুর দেখতে এসে ওটাও আলোচনা করতো বাচ্চারা — “ওটা আমার মায়ের শাড়ি, ওটা আমার কাকিমার”। কেউ কেউ আবার শাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে দিতেও চাইতো না। পুজোর খরচ ওই সবার বাড়ি থেকে চাঁদা নিয়ে হতো। কার বাড়িতে কত চাঁদা, সেটা একটা মিটিং করে ঠিক করা হতো। এখন চাঁদা বিল বই কেটে আদায় করা হয়, এবং কোনো কোনো বাড়িতে একাধিক রোজগেরে থাকলে তারা আলাদা করেও চাঁদা দেয়। গ্রামের প্রবাসীরা পুজোর সময় বাড়ি গেলে তারাও দেয়।
কয়েক বছর পরে গ্রামের লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুজোর খরচ করার ক্ষমতাও একটু বাড়লো। প্রাইমারী স্কুল থেকে পুজো উঠে এলো একটা পুকুর পাড়ে আলাদা প্যান্ডেল করে। আমাদের বাড়ি থেকে পুজোটা একটু কাছে হলো। খুব আড়ম্বর না হলেও, স্বতন্ত্র একটা প্যান্ডেল। ঠাকুর তৈরি করতো আমাদের গ্রামেরই এক ঘন্টাদা। এখন অন্য একজন ঠাকুর গড়ে। প্যান্ডেলও একটু উন্নত হয়েছে। আলোর মালা দিয়ে সাজানোও হয়। পুজো চিরকাল আমাদের গ্রামের পুরোহিত দিয়েই হয়। আগে পুজো করতেন শান্তি কাকা, আরো দুই জেঠু। তাঁরা তিনজনেই মারা গেছেন। এখন পুজো করে তাঁদের ছেলেরা।
ভবানীপুরের দুর্গাঠাকুর: 2015 |
রাধাবল্লভ পুর বড় গ্রাম। আয় একটু বেশি। তারা প্রতিবছর আলাদা প্যান্ডেল করতো, ঠাকুরের পিছনের ক্যানভাসে পাহাড়, ঝরণা এই সব আঁকাও থাকতো। ওদের ঠাকুরও তৈরি করতো ওদের গ্রামেরই শিল্পী। পুরোহিত আসতো বাইরে থেকে। প্রথম দিকে আমাদের জুনিয়র স্কুলের বাংলার মাষ্টারমশাই নন্দবাবু পুজো করতেন। বাইরে থেকে কাউকে আনা মানে টাকা বেশি দেওয়া। বেশি খরচ করার আনন্দটাও আলাদা।
রাধাবল্লভপুর গ্রামে পুজোটা যেখানে হয় সেটা আমাদের গ্রাম থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই। একটা লম্বা রাস্তা পেরিয়ে, একটু গিয়েই ওদের ঠাকুর। পুজোর কটাদিন ওই রাস্তাটায় ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এদিক থেকে ওদিকে যায়, ওদিক থেকে এদিকে আসে। প্রচণ্ড ভিড় হয় অষ্টমীর রাতে। আলোচনা - কাদের প্যাণ্ডেল কত ভালো, কাদের ঠাকুরের মুখটা কেমন? ওদের আলোর কায়দা হয়, এদের হয় না।
রাধাবল্লভপুরের ঠাকুর চিরকালই একটু অন্যরকমভাবে তৈরি হয়। ঠাকুরগুলো সাজানো থাকে বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পাহাড়, ঝর্ণা, জঙ্গল এইসব তৈরি করে তার ফাঁকে ফাঁকে। তুলনা চলতো ওদের দুর্গার সঙ্গে আমাদের দুর্গার, ওদের মহিষাসুর বেশি ভয়ঙ্কর না আমাদের, ওদের গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী কার মুখশ্রী কত সুন্দর। আলোচনা হতো — ভবানীপুরের ঠাকুরের প্যান্ডেলে আলোর কায়দায় আড়ম্বর না থাকলেও ওদের ঠাকুরের মুখ কিন্তু খুব সুন্দর।
আর দুজনদের মাইকের চোঙ সবসময় একে অপরের দিকে ঘোরানো থাকতো। কারা বেশি ভালো গান চালায় তারও একটা প্রতিযোগিতা।
ওদের পুজো প্যান্ডেলের সামনে বেলুন, চপ, ঘুগনি, পাঁপড়ভাজা এসবের দোকান বসতো। আমাদের কিচ্ছু থাকতো না। কিছুদিন পর থেকে বারোভাজা, আর শশা বসতো। শশা ছাড়িয়ে নুন দিয়ে বেচতো। এখন চাউমিনের দোকান অব্দি হয়।
দুই গ্রামের পুজো উদ্যোক্তারা প্রায় সব দর্শকের কাছেই জানতে চাইতো — “কি গো কেমন ঠাকুর হয়েছে? প্রসাদ পেয়েছো তো? চরণামৃত? পারলে একটু দক্ষিণা দিও।” এটুকুতেই তারা খুশি।
আমাদের গ্রামে 'ফকির পাড়া' বলে একটা পাড়া আছে। এক ঘর মুসলিম। তাদের হাঁড়ি ভাগ হয়ে এখন অনেক ঘর হয়েছে, কিন্তু শিকড় একটাই। তারাও অষ্টমীর দিনে লুচি করতো, নবমীর দিনে মাংস। বাচ্চারা নতুন জামা পরে মণ্ডপের সামনে খেলা করতো। ফকির পাড়ায় একটা মসজিদ আছে। সবাই শাহকামালের মন্দির বলে। সেখানে প্রতিবছর মাঘ মাসের আট তারিখ থেকে মেলা হয়। মেলাকে উপলক্ষ করে দুর্গাপুজোর মতই প্রবাসীরা অনেকে বাড়ি যায়।
রাধাবল্লভ পুরে হিন্দু-মুসলিমের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। আনন্দের ভাগটাও তাই ছিলো। মুসলিমরা অনেকে চাঁদাও দিতো। হাসিবা, হাসিনার সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে পুজো মণ্ডপের সামনে। জাকির কাকুকে আমি ওখানে ক্যারাম খেলতেও দেখেছি।
পাশাপাশি দু-তিনটে প্রতিবেশী গ্রাম। সবাই সবার অনুষ্ঠানে আনন্দ করে। ছোটখাটো এই আনন্দ নিয়েই তারা মেতে থাকে। চাপা একটা প্রতিযোগিতা থাকে বটে, তাতে আনন্দটাই প্রকট।
প্রতিযোগিতা নিয়েই সব মানুষ বেড়ে ওঠে। ভাইয়ে ভাইয়ে, বোনে বোনে, বন্ধুতে বন্ধুতে, স্কুলে স্কুলে, গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায়, রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে, দেশ বিদেশে। ছোট মাপ থেকে একটু একটু করে বড় মাপে। প্রতিযোগিতা সব যুগে, সব কালে, সব দেশে সবার মধ্যে থাকুক। সেটা হোক সবাই নিজের নিজের মত করে আরো ভালো হয়ে ওঠার আনন্দ নিয়ে। কাটাকাটি, হানাহানি, মারামারি ধ্বংসের রূপ নিয়ে নয়।
সবার মনে হিমেল হাওয়ার লাগুক পরশ। সবাই পাক শারদ শুভেচ্ছা।
Comments
Post a Comment