মহিলা কামরা - ৩

বহুদিন পরে সেদিন ময়ূরীকে দেখলাম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে অন্য এক দিদিমণিকে খুব উপদেশ দিচ্ছিলো। পাশে আরো কয়েকজন দিদিমণি তাঁদের স্কুলেও “ওই একই সমস্যা” সেটা বোঝাতে চাইছিলো। আমি একটু দূরে ছিলাম, তবুও বারবার  ময়ূরীর কথাই কানে আসছিলো। সে বলছিলো — “আরে তুমি এই বিষয়ে কম্পিটেন্ট। বলছি না তুমি খুবই কম্পিটেন্ট তাই HOD তোমাকে এটা নিয়ে কিছু বলবেন না।  আরে আমি বলছি তো, তুমি দেখো।” ওই একই কথা ঘুরে ফিরে নানান টোনে বলছিলো আর হেডফোন ঠিক করছিলো। তার হেডফোন এখন লাল থেকে সাদা হয়েছে। অন্য এক দিদিমণির মুখনাড়াটুকুই দেখতে পাচ্ছিলাম, কথা কিছু বুঝতে পারিনি। ট্রেন এসে গেলো।

ময়ূরী ট্রেনে উঠে সিট পেয়েই আবার হেডফোন গুছিয়ে বসলো। এর মধ্যেই স্বপনদা সুর করে — “বাসন মাজা স্কচ ব্রাইটটা পাবেন, চুলের ক্লিপ” — বলতে বলতে একটু দূরে চলে গেছে। ময়ূরী হঠাৎ চেঁচাতে শুরু করলো — “কাপড় কাচা ক্লিপ আছে? কাপড় কাচা?” সবাই হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে। স্বপনদাও তাই। তখন ময়ূরী চকিতে সম্বিত ফিরে বললো — “আরে ধুর্-র কি যে সব বলছি না..  ওই কাপড় মেলা, কাপড় আটকানোর ক্লিপের কথা বলছি।” স্বপনদা - “আছে”, বলে তার সামনে এসে হাজির হলো।

ময়ূরী জানতে চাইলো — “এক প্যাকেটে কটা থাকে?”
স্বপনদা — “বারোটা।”
— “কত দাম?”
— “পঁচিশ টাকা।”
ময়ূরী — “আচ্ছা এক প্যাকেট দিন, না না ঠিক আছে দু প্যাকেটই দিয়ে দিন” বলে পঞ্চাশ টাকা বের করে তার হাতে দিলো।

স্বপনদা একটা কালো ক্লিপের প্যাকেট তার হাতে দিতেই সে বলে উঠলো — “কালারফুল নেই? মানে বিভিন্ন রঙের ক্লিপ নেই?” স্বপনদা বললো “না বিভিন্ন রঙ হবে না, শেষ হয়ে গেছে। এটা আছে।” বলে হালকা সবুজ রঙের একটা ক্লিপের প্যাকেট বের করে দিলো। বলতে বলতেই চারদিক থেকে আরো অনেকে ওই ক্লিপের প্যাকেট নিয়ে দেখতে লাগলো। প্রায় চার-পাঁচটা প্যাকেট বিক্রি হয়ে গেলো। এর আগে কখনো স্বপনদার এতগুলো প্যাকেট বিক্রি হতে দেখিনি।

এর মধ্যেই দেখি একজন দিদি একটা প্যাকেট নিয়ে ময়ূরীর কোলে ফেলে দিলো। ময়ূরী তা থেকে বের করলো একটা লাইট ওরেঞ্জ কালারের সালোয়ার কামিজের পিস। তাতে অনেক সুতোর কাজ করা। ময়ূরী সেটা নেড়েচেড়ে দেখে বললো — “না গো। এমনটা তোমাকে বলিনি। সেটার হাতে আর কামিজের নিচটায় পাড়ের মতো কাজ থাকবে।” বলে সেই দিদিকে ফেরৎ দিয়ে দিলো। সেই দিদিও সেটা নিয়ে বললো — “হ্যাঁ পরে এনে দেবো।”
 
এই দিদিকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি। প্রথম দিকে ভাবতাম ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যেই একজন। একদিন দেখেছিলাম সে ট্রেন থেকে নেমে,  ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কয়েকটা ক্যাটালগ একজন দিদিমণিকে দিলো, এবং বলে দিলো পরেরদিন ফেরৎ নেবে, তারমধ্যে সে যেন ঠিক করে রাখে কোনটা কোনটা পছন্দ। ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিলাম ওটা ওরিফ্লেমের নেলপালিশ আর লিপস্টিকের ক্যাটালগ। এখন দেখছি সে চুড়িদার, সালোয়ার কামিজ পিসও ব্যাচে।

কথায় বলে খদ্দের লক্ষ্মী। দোকানদার বা হকার যদি নারায়ণ হয় তাহলে জমে ভালো। আমাদের এই ট্রেনে সত্যিই একজন নারায়ণ আছে। এই নারায়ণ খুব ফেমাস একজন পেয়ারাওলা। এ এসেই দিদিমণি দিদিমণি করে না। প্রথমেই কয়েকটা প্লাসটিক প্যাকেট বের করে। কোনোটায় চারটে, কোনোটায় পাঁচটা, কোনোটায় ছটা পটাপট ভরে যে দিদিমণিরা যেমন নেন, তাঁদের কাছে পৌঁছে দেয়। দিদিমণিরাও দেখেছি কোনো উচ্চবাচ্চ না করে যে যাঁর ব্যাগে ভরে নেন। কেউ কখনো বলেন না - নারায়ণ এটা এমন দিলে কেনো, ওটা অমন দিলে কেনো, বা এটা পাল্টে দাও, ওটা কেনো পাকা? নারায়ণের ওপর সবার অন্ধবিশ্বাস। নারায়ণ আবার শীতকালে জয়নগরের মোয়া ব্যাচে। অনেক দিদিমণির কাছে নারায়ণের ফোন নম্বর আছে। তাঁরা ফোন করে বলে দেন — “অমুক ট্রেনে কাল ওটা নিয়ে এসো, আমি ওই ট্রেনে থাকবো।”   

আর একদিন এক মহিলাকে দেখেই চমকে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো আমার সেজো পিসি। খুব লম্বা, ধবধবে ফর্সা, চোখা নাক, বড় লাল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর পরে, অবিকল আমার ওই পিসির মতো দেখতে। দেখতে দেখতেই ট্রেন এসে গেলো। আমি অন্যদিকে উঠলাম। উঠে সিট খুঁজতে খুঁজতে সেই মহিলার উল্টোদিকের সিটটাই পেলাম। বৃষ্টির জন্য সব সিটের জানলার দিক ফাঁকা থাকলেও শুকনো সিট খুঁজেই বসতে হচ্ছিলো। ওনার ঠিক মুখোমুখি আমি বসলাম। দু-মিনিট পরেই দাদু “চিঁড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা” হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছিলো। ওই মহিলা দাদুকে ডাকলেন।
— “একটা চিঁড়ে ভাজা দিন তো।”
— “কোনটা? সাদা না মশলা?”
— “নানা সাদাই দিন।”
দাদু সাদা প্যাকেট দিতেই মহিলা বললেন — “কেটে দিন।”

উনি সব গুছিয়ে টাকার ব্যাগ মেন ব্যাগে ভরে চিঁড়েভাজা খেতে থাকলেন। চশমার ভিতর দিয়ে চোখটা একবার ছোটো ছোটো একবার বড়ো বড়ো করে বারবার এমন করছিলেন মনে হচ্ছিলো তাকাতে যেন অসুবিধা হচ্ছে। 

এরপরে এক খুব বয়স্ক মহিলা এলেন ভিক্ষে করতে। তাঁর বয়স পঁচাত্তর তো হবেই। সবার কাছে হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইছিলেন। আমার ডান পাশের মহিলা দু- টাকা দিলেন। পিসির মতো মহিলাও দু-টাকার একটা কয়েন দিয়ে বললেন — “আপনি এই বয়সে ভিক্ষে করছেন কেনো? বাড়িতে থাকতে পারেন না?”
বয়স্ক মহিলা বললেন — “আমার দুই ছেলে-মেয়ে পাগল। আমি মরে গেলে তাদের কি হবে?”
— “তাদের হোমে দিয়ে আপনি কারো বাড়িতে থাকতে পারেন তো?”
তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদো কাঁদো চোখে অন্যদের দিকে পয়সা চাইতে গেলেন।
তখন ওই মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন — “এখন তো কত পাগলখানা আছে, তাই না? কোনো একটায় দিয়ে উনি তো কারো বাড়িতে থাকলেই পারেন। এই বয়সে উনি তাদের কথা ভেবে কি করবেন? কোনো সমাধান তো নেই। আমার বাড়িতেই তো এমন একজন থাকলে ভালো হয়, এদিক ওদিক বেরোতে পারি। একটা দায়িত্ব। আসলে ওরা অনেক মিথ্যে কথাও বলে গো। ভিক্ষে করলে তো প্রচুর ইনকাম। পার ডে প্রায় পাঁচশ-ছশো টাকা। কারো বাড়িতেই থাকলেও তো -  থাকা, খাওয়া, টাকা-পয়সা সবই পাবে।” 

এইসব কথা চলতে চলতে চলে এলো মোসাম্বিওলা।

“এই মোসাম্বি? মিষ্টি মোসাম্বিটা পাবেন।” এই ছেলেটা সত্যিই খুব হাসিখুশি। আমি একে সারাক্ষণ হাসতে দেখি। বিক্রি হোক বা না হোক। তবে বেশিরভাগ সময় ঝুড়ি খালি করেই নামে। মাঝে মাঝে আঙুরও বেচে। আজ একজন দিদিমণিকে লেবু দিতে দিতে হঠাৎ একগাল হেসে  আমাকে বললো — “দিদিমণি ভালো আছেন?”  ঘাড় নেড়ে বললাম “হ্যাঁ।”

ওই দিদিমণিকে কুড়ি টাকায় চারটে লেবু দেওয়ায় তিনি বললেন — “পাঁচটা হবে না?”  সে বললো — “না দিদিমণি, পাঁচটা তিরিশ টাকা হয়ে যায়। আপনাকে বলেই কুড়িতে চারটে দিয়েছি।” দিদিমণি বললেন “মিষ্টি হবে তো?” সে-  “হ্যাঁ” বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো।

এর পরেই সেই বয়স্ক মহিলা হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইতে চাইতে আবার হাজির। আমার ডানদিকের মহিলা বললেন — “এই তো আপনাকে পয়সা দিলাম।”  মহিলা তখন একটু ক্ষুব্ধ হয়েই বললেন — “যারা দিয়েছে তারা আর দেবে না। আমি তো এই একটা কামরাতেই থাকি। আর কোথাও উঠিও না নামিও না। তাই যারা নতুন ওঠে তাদের কাছে আবার চাই।”  বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন তখন তাঁর বাঁ হাতে বাঁধা বিপত্তারিনীর ডুরিটা দেখে আমার সেজোপিসির মতো দেখতে  মহিলা ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে টিপ্পুনি কাটলেন — "আবার বিপত্তারিনীর বার করেছে।”  

একজন মহিলা তাঁর পাশে জানলার ধারে সিটটায় বসতে চাইলেন। তিনি বললেন — “ভেজা তো বসবে কি করে?"
— “ভেজা তো আর কি করা যাবে, কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো?”
— “তাহলে ছাতাটা দিয়ে মুছে বসুন।” বলে নিজের ছাতাটা নিয়ে আমার বাঁদিকের ফাঁকা সিটে রাখলেন। তারপর আমাকে বললেন — “এখানে রাখছি তো, আবার ভুলে না যাই।”  বলেই তাঁর পুরোনো একটা গল্প বললেন — "একবার সব বন্ধুরা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়েছিলাম। আমি সিটের পিছনে ছাতা আর ব্যাগটা ঝুলিয়ে রেখে ছিলাম। নামার সময় দুটোই ভুলে গেছি। সে গাড়িও হাওয়া। বন্ধুরা কত বকেছিলো, বলেছিলো, তুই গাধা আছিস।” মনে পড়লো আমি আর আমার বর একবার এমন গাধা হয়েছিলাম। একবার দাদা বৌদিকে দেবার জন্যে পূজোর জামাকাপড় কিনে ফেরার সময় ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা সামনে বসে থাকা মহিলার হাতে ধরতে দিয়েছিলাম। কি একটা বিষয়ে দুজনের মধ্যে রাগারাগি হয়ে যাওয়ায় অন্যমনস্ক হয়ে প্যাকেটটা ভুলেই নেমে গিয়েছিলাম।  

ট্রেনটা হঠাৎ দুটো স্টেশন গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ততক্ষণে ভিড় অনেকটা বেড়ে গেছে। মাইকে কিছু একটা বললো কেউ শুনতে পেলাম না। এ ওকে জিজ্ঞেস করছে, সে তাকে, কিন্তু কেউই বলতে পারলো না কি অ্যানাউন্স করা হয়েছিলো। সবাই বিরক্ত। উফ! আফ! করছে। তার মধ্যেই হঠাৎ দূর থেকে একটা পুরোনোদিনের গান কানে এলো। কথা বুঝতে পারছিলাম না। পিসির মতো দেখতে মহিলা দেখলাম দিব্যি তাল দিয়ে আপন মনে ঘাড় নেড়ে যাচ্ছেন। এরপর কানে এলো “চুড়ি খনকে গি, বিন্দিয়া চমকেগি”। এটুকু হতে না হতেই শুরু হয়ে গেলো “আআই না কুচ খবর, মেরে ইয়ার কি…”। বুঝলাম কেউ তার মোবাইল থেকে গান চেঞ্জ করে করে পছন্দের গান বাছার চেষ্টা করছে। তখন আমার পছন্দের একটা গান চলে এলো। “এক পেয়ার কা এক নাগমা হ্যায়, মজোঁ কি রবানি হ্যায় … ”। কিন্তু  সে থামলো না, বাছতেই থাকলো। আমার কানে বাজতে থাকলো .. “জিন্দেগি অর কুচ ভি নেহি, তেরি মেরি কাহানি হ্যায়….”। ট্রেন চলতে থাকলো। 

আমার স্টেশন এলো। নামার আগে মহিলাকে ইশারা করে তাঁর ছাতাটা মনে করিয়ে দিলাম। তিনি হাসিমুখে আমাকে অনেক “ধন্যবাদ”, বলেই তাঁর হাতে থাকা চিঁড়ের আর একটা বিস্কুটের খালি প্যাকেট দেখিয়ে বললেন — “এগুলো স্বচ্ছ ভারতের জন্য রেখে দিয়েছি। ডাস্টবিন দেখতে পেলেই তাতে ভরে দেবো।”  আমি হাসতে হাসতে নেমে গেলাম।

নেমে লাইন পেরোনোর সময় ওই মহিলার কথা আর আমার সেজো পিসির কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি তীব্র হর্ন দিয়ে উল্টো দিকের ট্রেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকিয়ে মাপজোক করে দেখলাম আমি ট্রেনের আগেই দৌড়ে লাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মে উঠে যেতে পারবো। দৌড়ে উঠেও গেলাম। একটা চৌকিতে বসে চারজন তাস খেলছিলো। আমি উঠতেই জোরে চেঁচিয়ে বললো — “যেদিন ট্রেনের তলায় যাবেন বুঝবেন।” অন্য একজন বিড়বিড় করে বললো — “সাহস আছে বলতে হবে।”

আরো পরে আমার কলিগ বললো — “আমি তো নিজে দাঁড়িয়ে তোর নাম ধরে চিৎকার করছিলাম। তুই  শুনতে পেলি না। দেখলাম দৌড়চ্ছিস…।”

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত