মহিলা কামরা

— “তুমি গলায় ওটা কি হার পরে আছো – রূপোর?”
— “নানা এটা এমনি, রূপো নয়।”
— “তুমি সাজো না কেনো? এইটুকু বয়স। এই বয়সে তোমরা সাজবে না তো কি আমরা সাজবো? যদিও তোমাদের বয়সেও কিছু এমন সাজিনি। আমি আমার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের বলি তোরা সাজবি। সাজলে আমার খুব ভালো লাগে। তখন আমরা সাজিনি ভুল করেছি।”
দুই মহিলা আর একটি অল্প বয়সি মেয়ের গল্প। কেউই কাউকে খুব বেশি চেনেন না। মাঝে মাঝে দেখা হয় এটুকুই। আমার মতই এঁরা সবাই লোকাল ট্রেনে রোজ যে যার কাজে যান। তাড়াতাড়ি ক্লাস থাকলে আমি নটা ছত্রিশের ট্রেনে যাই, নইলে দশটা সাতের। ট্রেন সাধারণতঃ দশ মিনিট দেরি করেই আসে, কিন্তু সেই দেরির উপর ভরসা করা যায় না। তাই অধিকাংশ দিনই আগে আসলে স্টেশনে অপেক্ষা। অফিস টাইমে খুব ভিড় থাকে তাই, আর কোনো পুরুষ কলিগের সঙ্গে দেখা না হয়ে গেলে মহিলা কামরাতেই যেতে পছন্দ করি। ঐ সময়ে নানা স্কুলের বহু দিদিমণিও যান। আমার কলেজ ছাড়া অন্যান্য কলেজের কিছু দিদিমণিকেও যেতে দেখি। তবে তাঁরা খুব চুপচাপ। কখনো কখনো নিজের পরিচিত কাউকে পেলে গল্প করেন, না হলে পেপার পড়তে পড়তে বেশ একটা গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে কপাল উঁচু করে  চশমার ফাঁক দিয়ে কামরার গতিবিধিতে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। অতিরিক্ত চেঁচামেচি মনে হলে চোখে মুখে বিরক্তিও ফুটে ওঠে।
যাবার পথে আমার বাড়তি পাওনা বলতে অন্য মহিলাদের কথোপকথন – কামরার বাইরে ও ভিতরে যা যা শুনি। স্কুলের দিদিমণিরা বেশ হৈহৈ করতে করতে যান। আধঘন্টা অন্তর এক একটা ট্রেন, আর মহিলা কামরাও মাত্র দুটো। তাই একই স্কুলের না হলেও প্রায় সবাই একে অপরকে চেনেন, নাম জানেন, গল্প করেন। আমি নিজে খুব মুখচোরা। সেধে সেধে কারো সঙ্গে আলাপ করা আমার ধাতে নেই। কিন্তু আমি এখন সবাইকে রোজ দেখতে দেখতে চিনে গেছি, কারো কারো নামও জানি। আমাকেও হয়তো সবাই চিনে গেছে। কিন্তু কথা হয়না। শুধু একটি মেয়ে আছে – সুতপা – যার সবার সঙ্গে সহজে আলাপ করে নেবার গুণ আছে, তাই আমার সঙ্গেও তার আলাপ হয়েছে। তার সঙ্গেই শুধু কথা হয়। সে আমার কলেজের পাশেই একটা স্কুলে পড়ায়, তাই মাঝে মধ্যে আমরা একসঙ্গে যাই রিক্সা শেয়ার করে। এঁদের সকলকেই আমার ভালো লাগে, তবু যাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ নেই এই লেখায় তাঁদের নামটুকু পাল্টে দিলাম।
ঐদিন ঐ দুই বয়স্ক মহিলা তাঁদের মেয়ের বয়েসি মেয়েটিকে সাজতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। একজনের পরে অন্য বয়স্ক মহিলাও বলে উঠলেন – “হ্যাঁ আমিও আজ অবদি কোনোদিনও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাইনি। ওই একটু ভেসলিন, ব্যাস সাজ হয়ে গেলো। আজকাল মেয়েরা কি একটা ন্যাচারাল কালার এনে দিয়েছে ওটা ঠোঁটে লাগিয়েই আবার একটু আঁচল দিয়ে মুছে নি। কেমন লজ্জা লাগে নাহলে। আমার মেজো মেয়ে আবার সাজতে খুব ভালোবাসে। হাত ভরতি করে শাঁখা পলা চুড়ি, সিঁথিতে চওড়া করে আবার সিঁদুর। ছোটো মেয়ে আমার ঠিক তার উল্টো। সে মেজো মেয়েকে  বলে এতো সব পারবোনা বাবা তোর মতো। অতি ভক্ত (ভক্তি) চোরের লক্ষণ জানিস তো? ভালোবাসা বাবা এখানে থাকে আমার বুকে আছে। বাইরে অতো দেখানোর কিছু নেই।” মহিলা একটা হাত বুকে রেখে দেখালেন সে কি ভাবে বলে। “ছোটো মেয়ে হাতে শুধু ওই পলাটুকুই পরে থাকে। কখনো আবার স্টাইল করে ওসব খুলে অন্য চুড়িও পরে।” অল্প বয়সি মেয়েটিও সায় দিল – “হ্যাঁ আমারো ওই অতো হাত ভরতি চুড়ি গয়না সব ভালো লাগেনা।” এই বলতে বলতে ওরা সবাই ট্রেনে উঠে গেলো, এর পরের কথা আর আমার কানে এলোনা।
একদিন এক দিদিমণি আর এক দিদিমণিকে বলছিলেন – “বেরিয়েছিলি ওইদিন?” — “হ্যাঁ। বেরিয়েছিলাম। মিমিকে (মেয়ে) বলেছিলাম তুই যদি সারাদিন পড়িস তাহলে তোকে নিয়ে যাবো। বেচারি পড়েছিলো সারাদিন, বিকেলে আর পারছিলো না। কেমন করে যেন তাকাচ্ছিলো। বললাম একটু ঘুমিয়ে নে তারপর বেরোবো। বলা মাত্রই শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো। কাল ফিরে শুনলাম ম্যাথের ক্লাসে যায়নি। সারাদিন টিভি দেখেছে। আমি গিয়েও দেখি টিভি দেখছে। আমি কিছু না বলে টিভিটা বন্ধ করে দিলাম। সেও কিছু বলার প্রয়োজন মনে না করে আবার চালালো। আমি আবার বন্ধ করে দিলাম। রেগে গিয়ে বললো তুমি বারবার অমন করো কেনো? বললাম কাল ম্যাথের ক্লাসে যাওনি কেনো? শুনে মাথা নিচু করে বসে রইলো।” সেটা তিনি দেখালেন কিভাবে বসেছিলো। “আজকেও স্কুলে বেরোনোর সময় দেখলাম টিভি খুললো। আমি বললাম এই দ্যাখ ব্যাগে করে জামাকাপড় নিয়ে যাচ্ছি আর বাড়ি ফিরবো না। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো না মা তুমি বাড়ি ফিরো, যেয়োনা মা।” তাঁর প্রতি মেয়ের এই আকুলতার বর্ণনা দিয়ে কিছুটা তৃপ্ত হয়ে মহিলা একটা বড়ো হেডফোন বের করে, গ্যালাক্সি ট্যাবে লাগিয়ে হাসিমুখে গান শুনতে লাগলেন। অন্য দিদিমণি কি একটা বললেন, আমি শুনতে পাইনি। সম্ভবত ট্যাবটার সম্পর্কে কিছু। মহিলা তখন কান থেকে হেডফোনটা খুলে শুনে নিয়ে বললেন – “হ্যাঁ আমি লজ্জায় এটা বের করিনা, ভাবি কে কি বলবে!!”
সেদিন দুজন দিদিমণির কথা হচ্ছিল – “এই ময়ূরী তুমি তোমার স্কুলের অমুককে এই কানের দুলটা দিয়ে দেবে? আমাকে কিনতে দিয়েছিলো। শুক্রবার থেকে ব্যাগে নিয়ে ঘুরছি তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।” ময়ূরী বলল – “হ্যাঁ হ্যাঁ দিয়ে দেবো, কেনো দেবনা। আমার সঙ্গে তো দেখা হবেই।” বোঝা গেল, ময়ূরী আর তিনি একই স্কুলের নন। ময়ূরী আরো বললো – “ও তো ব্যাটা আমার কপিক্যাট। আমি যা কিনি ওরও তাই কিনতে হবে। এই কানের দুলটা এই যে আজ আমি যেটা পরে আছি সেরকম।” আমি তখন তার কানের দুলটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। যে মহিলা কিনেছেন তিনি দুলের বাক্সটা ময়ূরীকে দিতে দিতে বললেন – “এই বক্সটা তো আবার বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি, এইটুকু দুল তার এতোবড়ো বক্স। ব্যাগে বয়ে বেড়াতে অসুবিধা না?” বাক্সটা তিনি ময়ূরীকে দিলেন, আর সেটা তেরো হাত হলেও ময়ূরীকে তার ব্যাগে ভরে নিতেই হলো।
বয়স্ক দুই দিদিমণির একজন ময়ূরীকে বললেন – “জানোতো আমার মেয়ের কোমর চব্বিশ, তার জিন্স আবার কোথাও পাওয়া যায়না। ওই একটা দোকান আছে সেখান থেকে পাই, সেও যাওয়ার টাইম হচ্ছেনা। আমি মেয়েকে বলেছি তোরা স্কুল থেকে চলে যাবি। তখন আবার দোকান বন্ধ থাকে।” ময়ূরী বুদ্ধি দিলো – “কেনো কোনো একটা মলে চলে যেতে পারো তো? সেখানে সব পেয়ে যাবে। সাউথ সিটিতে গিয়ে দেখো। ওদের আবার সব আলাদা আলাদা মাপ হয় জানোতো। হয়তো ছাব্বিশের স্মলটা তোমার মেয়ের কোমরে হয়ে যাবে। আর একটা আছে কোয়েস্ট মল। সেটা অবশ্য আমি কখনো যাইনি। ওই বন্ধুদের কাছে শুনেছি। এক্স্যাক্টলি কোথায় বলতে পারবোনা তবে ওই পার্কসার্কাস আর বালিগঞ্জের মাঝে কোথাও একটা হবে। তবে সেখানে গিয়ে আমরা খাপ খুলতে পারবো বলে মনে হয়না। বন্ধুদের কাছে যা শুনি – বাপরে!!” আমার মনে পড়ল আমিও একবার গিয়েছিলাম কোয়েস্ট মলে। একটা ব্যাগের দোকানে ঢুকে ব্যাগ দেখতে দেখতে সরল মনে একটা ব্যাগের দাম জানতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কত আর হবে, দুই তিন, বড়জোর পাঁচ-ছয় হাজার হবে। সেটার দাম ছিল সাঁইত্রিশ হাজার।
একটি লম্বা ঢ্যাঙা মেয়ে, মোটা – চৌকো কালো ফ্রেমের চশমা, ছেলেদের মতো প্যান্টশার্ট ইন করে পরা। ট্রেন থেকে নামার ঠিক আগে ময়ূরীকে কোনো সম্বোধন না করেই বললো – তোমার ব্যাগটা তোমার ড্রেসের সঙ্গে বেশ ভালো যাচ্ছে। ময়ূরী প্রথমে কম্প্লিমেন্টটা খেয়াল করেনি। পরে তাকিয়ে বলল – “ওহ! থ্যাংক ইউ। আমি এখন চুটিয়ে অনলাইন শপিং করছি। বাট তোমাকে লুকিং নাইস। একটু বেশ মোটা হয়েছো ভালো লাগছে। লুকিং বিউটিফুল অ্যাকচুয়ালি।” এতো প্রশংসা করলে খুশি না হয়ে পারা যায় না। মেয়েটি বেশ হাসিমুখে বলল – “সত্যি বলছো?” নিজের প্রতি একটু চোখ বুলিয়ে আবার বলল – “বিচ্ছিরি মোটা লাগছে না তো?” — “নানা একদম নয়। খুব ভালো লাগছে। আগে যেমন তোমাকে হাড় জিজ্জিরে লাগতো এখন সেটা মনে হচ্ছেনা। যাক খুব ভালো লাগলো তোমার সঙ্গে এতোদিন পর দেখা হয়ে।” — “হ্যাঁ বাই আসি আবার দেখা হবে” – বলে মেয়েটি চলে গেল।
আমি ওই লম্বা মেয়েটিকে আগেও কয়কবার দেখেছি, শাড়িতে। বয়সটা বুঝতে পারতামনা। একদিন সে চুপচাপ বসে বসে দুটো বাচ্চা মেয়ের কথোপকথন শুনে ঘাড় নাড়ছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। মেয়ে দুটো একে অপরকে সিনেমার ডায়ালগ জিজ্ঞেস করছিলো। যে জিজ্ঞেস করছিলো সে খুব পাকা। সে পটাপট একটার পর একটা ডায়ালগ বলছিল আর অন্য মেয়েটা খুব রেগে যাচ্ছিল – “ধূর! তোর একটাও মনে নেই? তুই কিচ্ছু জানিস না।” তখন অন্য মেয়েটার হঠাৎ একটা মনে আসতেই “আমি বলবো বলবো” করে বলতে শুরু করেছিল — “এক চুটকি সিন্দুর…..”।
একই স্কুলের দুই অল্পবয়সি দিদিমণি। এদের মধ্যে একজন বিবাহিতা। অন্যজন তাকে বলছিলো – “তুমি কেনো অমন গোলা সিঁদুর লাগাও বলো তো? ভালো লাগে? আমার মা লাগায়, আমার একটুও ভাল্লাগেনা, আমি মা’কে বকি। বাপি আবার ইয়ার্কি মেরে বলে চাপ নেই, না লাগালেও চলবে। তবে আমাদের বাড়িতে ওই হাতেরগুলো নিয়ে খুব চাপ জানোতো! শাঁখা পলা একেবারেই খোলা চলবে না। সে বেড়ে গেলেও খুব ঝামেলা। বেড়ে যাওয়া বোঝো তো?” এটা বোঝা খুব দরকারি, তাই বিবাহিতা মেয়েটি “হ্যাঁ বুঝি।” বলার পরে তবেই সে আরো বলতে থাকলো – “ওই সময় হাতে কিছু একটা গলিয়ে – সেটা রাবার ব্যান্ড হলেও চলবে – আগে শাঁখা পরে আসতে হবে। আমার ঠাকুমা এ ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। এমনকি কেউ সোনার শাঁখা বাঁধানো পরবে তাও চলবেনা। আমার জেম্মা যখন বাপের বাড়ি যায় লুকিয়ে চটপট ওইসব হাতে পরে নেয়। আমার বাপি খুব খেপে যায়, মনে মনে ভীষণ গরগর করে। নেহাত বউদি হয় বলে কিছু বলতে পারেনা।” এইসব বলে মেয়েটি একটু দুশ্চিন্তা করতে লাগল — “হে ভগবান আমার যে কি হবে যদি অমন শ্বশুর বাড়ি হয়! আমি একটুও গয়নাগাটি পরতে পারিনা। কিন্তু আজকাল তো অনেকেই এমন আছে গো যারা কিচ্ছু পরেনা।” এটা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সুতপা বলল – “হ্যাঁ আছে তো।” পাশে দাঁড়িয়ে এক মহিলা সব শুনে বিজ্ঞের মতো বললেন – “যদি এপারে থাকো চাপ আছে, ওপারে কোনো কথা নেই, কে দেখতে যাচ্ছে।” তাঁর এপার ওপারের মর্ম আমি বুঝলাম না। হয়তো সমুদ্রের এপার বা ওপার, অথবা কলকাতার এপার ওপারও হতে পারে। মেয়েটি বলল – “আমি যখন জিন্স পরি, বেড়াতে যাওয়ার সময়, তখন শাঁখাটা খুলে শুধু লোহাটা পরে থাকি। ওখানে গিয়ে লোহাটাও খুলে ফেলি, সিঁদুরও পরিনা।” — “তোমার বর কিছু বলেনা?” মিষ্টি করে হেসে — “না, আমার বর খুব ভালো। সে এসব নিয়ে কিছু বলেনা।” অবিবাহিতা মেয়েটি বান্ধবীর সৌভাগ্যে মুগ্ধ –  “আর তোমার কি ভাগ্য না? সকাল আটটায় উঠে শাশুড়ির রান্না ভাত খেয়ে বেরিয়ে আসো।” বউমার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। “হ্যাঁ আমি বিয়ের আগেও অমন ছিলাম। আমি বিছানার মাঝখানে বসে থাকতাম আর আমার চারপাশে সমস্ত বই ছড়ানো। আমি মোটামুটি ওখানেই থাকতাম, আমার মা সব খাবার এনে এনে খাইয়ে দিতো। মায়ের তো খুব চিন্তা হয়ে গেছিলো! এ মেয়ে কিচ্ছু কাজ জানেনা, একে কে বিয়ে করবে!! যাক এখন শান্তি! আমার শ্বশুর বাড়ি খুব ভালো।” “হুম! সে তো বোঝাই যাচ্ছে তোমাকে দেখে।”
টিচার্স ডে’র দিন স্টেশন পৌঁছেই সব দিদিমণিদের দেখে মনে হলো কোথাও একটা বিয়ে বাড়ি আছে। একে অপরকে বলছে – “তোমাকে দারুণ লাগছে”, “তোমার শাড়িটা খুব সুন্দর”, “কানের দুলটা ভালো ম্যাচ করেছে।” বরং যারা শাড়ি পরে আসেনি তাদেরকে হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। কৈফিয়ত দিতে হলো কেনো শাড়ি পরেনি। সুতপা তো বলেই ফেললো – “পরলে মাঝরাস্তায় খুলে যেতো!” সুতপা সেই অল্পবয়সি বিবাহিতা মেয়েটার কানের দুলটা আমাকে দেখিয়ে বললো “কাল ও ওটা ট্রেন থেকেই কিনেছে।” ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ ময়ূরী এসে হাজির হলো একেবারে ট্রেনের সামনেই, আর সবাই মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়ল – “তুমি শাড়ি পরোনি কেনো?” ময়ূরীএককথায় সবাইকে উড়িয়ে দিলো — “ধুত তোর নিকুচি করেছে শাড়ির” – বলে প্রবল অবজ্ঞায় মুখ ব্যাজার করলো। তার মধ্যেই একজন তার হাতের চুড়িগুলো ময়ূরীকে দেখালো। তাতে দেখা গেলো সেও ওর মতো একই চুড়ি পরেছে। চোখাচোখি করে দুজনে হাসি বিনিময় করলো আর বললো সেও ওই মেয়েটার থেকেই ট্রেনে কিনেছে। ময়ূরী পরেছিলো লং কুর্তির সঙ্গে লেগ-ইন্স। তাতেও সাজ ছিলো খুবই পরিপাটী। ইনফ্যাক্ট রোজই তাই থাকে।
ট্রেনে ওঠার পরে আমি আর সুতপা মুখোমুখি বসলাম। সুতপা সঙ্গে সঙ্গে তার সামনের মহিলাকে বললো “তোমাকে ভালো  দেখাচ্ছে।” তিনি প্রশংসাটা যেন প্রত্যাশাই করছিলেন। জানতে চাইলেন “শাড়ির রংটা ভালো না?” সুতপা বললো “হ্যাঁ।” তিনি বললেন “এটা বিয়েতে পেয়েছিলাম। বর্ষা বলে এতোদিন বের করিনি।” যারা শাড়ি পরেনি তাদেরকে শুনতে হলো “আজকের দিনটাতেও পরতে পারলে না? বছরে তো একটা দিন-ই আমাদের, এটাতেও সাজবো না?!”
ট্রেনের এই মহিলা কামরায় তপনদা বা তপতীদিরও যথেষ্ট অবদান আছে। নানা, তারা কোনো স্কুলের দাদা বা দিদি নয়। তারা হকারমাত্র।
তপনদা বেচে জোয়ান, আমলকী, আনারদানা। দিদিমণিদের মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করে সে জনপ্রিয়। একদিন ট্রেনের সিটে রাখা একটা ব্যাগ দেখে শ্রেয়া খুব জোরের সংগে বলেছিলো এটা নির্ঘাত তপনদার ব্যাগ। অমুকদি ব্যাগটা নামিয়ে দাও তো। শ্রেয়া আমার পূর্ব পরিচিত। আমার কলেজের পাশে একটা স্কুলের দিদিমণি। তপনদা ফিরে আসার পর শ্রেয়া একগাল হেসে বলেছিলো — “তোমার ব্যাগটা নামিয়ে দিয়েছি। তপনদা তোমার কাছে ওই ক্রিস্টাল জোয়ানের প্যাকেটটা আছে?” — “না আজ নেই গো!” শ্রেয়া ঠোঁট উল্টে “যাহ!” বলে দু:খ প্রকাশ করে একটু হালকা ধমকও দিয়েছিলো। তপনদা বুঝেছিলো না থাকাটা অপরাধ। শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলো নেক্সট দিন এনে দেবে।
তপতীদি বেচে শাড়ি, সালোয়ারের পিস। সেও সকলের মধ্যে খুব প্রিয়। কোনো কোনো দিদিমণিকে বলতে শুনেছি – এই দ্যাখো তপতীদি “তোমার থেকে কেনা শাড়ি পরেছি।” তপতীদি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে – “এই দ্যাখো আমার দেওয়া অথচ আমিই চিনতে পারিনি। তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তোমার রংটা বেশ খুলেছে এই শাড়িতে। তুমি তো এমনিতেই সুন্দর, যা পরো তাতেই মানায়। তবুও আমার দেওয়া বলে বলছিনা, এটায় সত্যিই তোমাকে দারুণ লাগছে।” পাশ থেকে হঠাৎ একজনের আবদার, তার পাশে বসা একজনকে হাত দিয়ে দেখিয়ে, “তুমি এই দিদিকে সেদিন যে শাড়িটা দিলে সেরকম আমাকে একটা এনে দিওনা প্লিজ। আর শোনো ওই যে ওই শাড়িটা সেই হলুদ জমিন জরির কালো পাড়, মনে পড়ছে?” একটু ভেবে নিতে এটা তপতীদির মনে পড়ল – “হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।” শাড়ির অর্ডার দেওয়া হল – “ওটা বারোটা মতো নিয়ে আসবে। আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে ওইদিন আমারা সবাই একই শাড়ি পরবো।” তপতীদি “ঠিক আছে” বলে মিনতিদির খোঁজ করতে লাগলো। তার থেকে ও টাকা পাবে। এদের সঙ্গে রোজ রোজ চলতে চলতে এতোটাই বিশ্বাস জন্মে গেছে যে তপতীদি ধার-বাকিতেও শাড়ি বেচে। এমনি একদিন এক ফলওয়ালাকেও বলতে শুনলাম – “দিদিমণি আপনার তিনশো টাকা হয়েছে। আজ দেবেন?” দিদিমণি ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিলেন। এই তপনদা, তপতীদির মতো আরো অনেক জনপ্রিয় দাদা দিদি আছে যারা রুমাল, চুলের ক্লিপ, বাসনমাজার স্কচ ব্রাইট থেকে সেফটিপিন অবধি বিক্রি করে।
যদি আরো অনেক বছর এই কলেজে পড়াই, কলকাতার যেখানেই থাকি না কেনো সম্ভবতঃ এই ট্রেনেই যাতায়াত করবো। কারো কারো জীবন হয়তো পাল্টে যাবে, হঠাৎ কোনো একদিন থেকে সে আর আসবে না। আবার নতুন অনেকেও হয়ে উঠবে সহযাত্রী। মুখচোরা হলেও ধীরে ধীরে হয়তো আরো কারো কারো সঙ্গে আমারো পরিচয় হয়ে যাবে। দশ মিনিট স্টেশনে অপেক্ষা, আর ট্রেনে পনেরো – কুড়ি মিনিট মিলিয়ে দিনে মাত্র আধঘন্টা। তাও জীবনের একটা অংশ এই ট্রেনে যাত্রা, এই মহিলা কামরা।

Comments

Popular posts from this blog

অন্ধকারের উৎস হতে

সবজিওয়ালা - ২

কুলকুলতির ব্রত